
শ্রীমঙ্গল মানেই চা-বাগান, পাহাড়ের ঢালু সবুজ গালিচা, কুয়াশাভেজা সকাল আর বৃষ্টির স্নিগ্ধতা। এখানকার বাতাসে যেন চা পাতার সুবাস লুকিয়ে থাকে। এই সবুজের রাজ্যে যখন ১৯৫০ দশকের শেষ দিকে তৈরি হতে থাকে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট বা BTRI—তখনই ভাবা হয়, শুধু বিজ্ঞান আর গবেষণাগার দিয়ে তো মানুষের মন ভরে না। দরকার একটা এমন জায়গা, যেখানে মনের শান্তি, আত্মার পরিশুদ্ধি, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে নিঃশব্দ আলাপ হয়।সেই ভাবনা থেকেই গড়ে ওঠে BTRI জামে মসজিদ।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সাথে কথা হলে জানাযায়, ১৯৫৭ সালের দিকে চা বোর্ডের নির্দেশে যখন পুরো ক্যাম্পাসের নকশা করা হয়, তখন এক কোণায় আলাদা করে রাখা হয় মসজিদের জন্য। অন্য কোনো জাঁকজমকপূর্ণ মুঘল গম্বুজ নয়, কোনো জটিল শিলালিপি নয়—একটি সাদামাটা শ্বেত পাথরের স্থাপনা। যেন চা-বাগানের নীরব সবুজের মাঝে একটি সাদা বিন্দু, পবিত্রতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মসজিদটি বিশাল নয়। একতলা, সামনে ছোট বারান্দা, ভেতরে খোলা নামাজঘর। মেহরাবের দিকে তাকালে মনে হয়, কত মানুষের নিঃশব্দ প্রার্থনা জমেছে এখানে! ছাদের পলকা ফ্যান ঘুরে, দূরের বাগানের ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যায়—আর হয়তো কেউ চোখ বুজে কোরআনের আয়াত পড়ে চলে ধীরে ধীরে।
BTRI-এর বিজ্ঞানীরা দিনভর মাঠে গবেষণায় থাকেন—মাটি, পাতা, রোগবালাই। কিন্তু দুপুরে, বিকেলে, বিশেষ করে জুমার দিনে তারা আসেন এই মসজিদে। এখানে তাদের পদমুদ্রা, কণ্ঠের আজান আর সম্মিলিত আমিন ধ্বনি মিশে থাকে শ্রীমঙ্গলের বৃষ্টির গন্ধে।
মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ হয় ইনস্টিটিউটের অর্থেই। কখনো রং করা হয়, কখনো ছাদের ফাটল মেরামত। বড় কোনো সংস্কার হয়নি—হয়তো এই সরলতা নিয়েই সে বাঁচতে চায়। এ মসজিদ দেখলে মনে হয়, ‘আলাদা’ হওয়ার চেষ্টা নেই—শুধু সেবা করার, আশ্রয় দেওয়ার এক নীরব প্রয়াস।
যারা এখানে নামাজ পড়েন, তাদের অনেকেই বলবেন—এটা শুধু একটা নামাজঘর নয়। এখানে আসে নিজের সাথে কথা বলতে, কাজের ক্লান্তি ভোলাতে, গাছগাছালির ভেতর একটু শান্তি পেতে। এ যেন গবেষণার কঠোর বিজ্ঞান আর অন্তরের নরম অনুভূতির সেতু।
শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান আর গবেষণার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই ছোট সাদা মসজিদ এক অর্থে সেই কালেরও সাক্ষী। দেখেছে দেশের পরিবর্তন, মানুষ বদলেছে, চা বাগানের মালিকানা বদলেছে—কিন্তু মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজান বদলায়নি।
আজও যখন বৃষ্টি নামে শ্রীমঙ্গলে, BTRI ক্যাম্পাসের সবুজ জমিতে ছোট ছোট জলধারা বেয়ে যায় মসজিদের শাদা দেয়ালে। আর ভেতরে কেউ হয়তো নিঃশব্দে সিজদায় পড়ে থাকে। এ মসজিদ যেন বলে—সব কাজ, সব গবেষণা, সব সাফল্যের পরেও, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই সৃষ্টিকর্তার দাস।
শ্রীমঙ্গলের BTRI প্রধান ক্যাম্পাসে অবস্থিত এই জামে মসজিদটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১৯৫৭। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চা বোর্ড (বর্তমানে বাংলাদেশ চা বোর্ড) এটি প্রতিষ্ঠা করে। সাদামাটা শ্বেতপাথরের প্রলেপ, ছোট বারান্দা আর শীতল পরিবেশে তৈরি এই মসজিদ স্থানীয় মুসল্লি, কর্মকর্তা ও গবেষকদের নামাজের জন্য একটি নিরিবিলি আশ্রয়।
রাজু