
৩০০ বছরের পুরনো মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় এলাকায় প্রাচীন আট—আনী জমিদার বাড়ি বা রাজবাড়ী নামে এটি পরিচিত । ময়মনসিংহ থেকে মাত্র ১৬ কিঃ মিঃ পশ্চিমে ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল–জামালপুর মহাসড়কের সংযোগ স্থল থেকে মাত্র ১ কিঃ মিঃ উত্তর পূর্বদিকে মুক্তাগাছার রাজবাড়ির অবস্থান। জমিদার ব্রিটিশ রাজন্য কর্তৃক প্রথমে রাজা এবং পরে মহারাজা উপাধি পেয়েছিলেন বিধায় জমিদারের বাসভবন রাজবাড়ী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার আচার্য চৌধুরী বংশ মুক্তাগাছা শহরের গোড়াপত্তন করেন। আচার্য চৌধুরী বংশ শহরের গোড়াপত্তন করে এখানেই বসতি স্থাপন করেন। আচার্য চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী ছিলেন বগুড়ার বাসিন্দা। তিনি মুর্শিদাবাদের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন নবাবের খুবই আস্থাভাজন। নবাবের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১১৩২ সালে তিনি সেই সময়ের আলাপসিং পরগণার বন্দোবস্ত নিয়ে ছিলেন। মুক্তাগাছা শহরস বেশিরভাগই ছিল তৎকালীন আলাপসিং পরগণার অন্তর্ভুক্ত।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নানা কারণে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর চার ছেলে বগুড়া থেকে আলাপসিং-এ এসে বসবাসের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর এই চার ছেলে হচ্ছে রামরাম, হররাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম।
তারা বস্তি স্থাপনের আগে পরগণার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ফিরে দেখে ছিলেন এবং সে সময়ে আলাপসিং পরগণায় খুব একটা জনবসতি ছিল না। সে সময় চারদিকে ছিল. অরণ্য—জলাভূমি। শ্রীকৃষ্ণ. আচার্য্যের ৪ ছেলে ব্রহ্মপূত্রের শাখা নদী আয়মানের তীরবর্তী স্থানে. নৌকাটা ভিড়িয়ে. ছিলেন. ।
মুক্তাগাছার জমিদারদের একজন হরেরাম । এই হরেরামের বাড়িটি হচ্ছে বর্তমানে রাজবাড়ী। প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর মেজো ছেলে। এ বংশের জমিদার আটানি বাড়ির জমিদার বলে পরিচিত ছিলেন। আটানির জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরীরর সুনাম ছিল অনেক। জগৎ কিশোরের চারপুত্র জীতেন্দ্র–বীরেন্দ্র, নৃসিংহ–ভূপেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী। জীতেন্দ্র কিশোরের. পুত্র হচ্ছেন জীবেন্দ্র কিশোর. আচার্য চৌধুরী ।
★ঘূর্ণায়মান নাট্যমঞ্চে আগত শিল্পীবৃন্দ!
শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি সেবায় মুক্তাগাছার রয়েছে বর্ণাঢ্য অতীত। রাজা জগৎকিশোরের বাড়িতে কখনো কালের সাক্ষী নাট্য মন্দিরটিকে দেখতে পাওয়া যায় যেখানে উদয় কুমার, কাননবালা, নানু সাহাইয়া, সরোদী আহম্মদ আলী খান, রাজপুরাতন বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী মোহন প্রসাদ প্রমুখ বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন শিল্প ধ্যানে।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার নাটকের ঐতিহ্য দীর্ঘকালের। এখানকার সাংস্কৃতিক পরিমল এক সময় ছিল অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ। নাটক, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতিতে ছিল মুক্তাগাছার জমিদারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আর নাটক আরও জনপ্রিয় করেছে এই ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। জমিদার জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরীর ছেলে কুমার ভূপেন্দ্র কিশোর ছিলেন নাটকপ্রিয়। ভূপেন্দ্র কিশোরের নামানুসারেই ভূপেন্দ্র রঙ্গপীঠ নামে মঞ্চটি তৈরি করা হয়। এটি ছিল কলকাতার বাইরে এশিয়ায় প্রথম এ ধরনের মঞ্চ।
উনবিংশ শতাব্দীর ৩০ শের দশকেই যে মুক্তাগাছায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল, এটাই তারই বাস্তব প্রমাণ। মঞ্চের দুই পাশে ছিল হারমোনিয়াম ও তবলাবাদকের জন্য আলাদা–আলাদা দুইটি স্থান। দক্ষিণে শিল্পিদের বিশ্রামগৃহ, পেছনে ছিল গ্রিনরুম.। পাশেই ছিল প্রকোষ্ঠ, তাতে ছিল লোহার তৈরি ছোট কিছু সিন্ধুক। আরও জানা যায়, জমিদাররা শিল্পিদের নিয়ে আসতো সুদূর কলকাতা থেকেই। শীতকাল ধরেই এখানে বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হতো।
★গুনীজন যারা এসেছিলেন।
ইতিহা সবিদ. কেদার নাথর মজুমদার, কবি দিনেশ চরণ বসু, শ্রী নাথচন্দ্র, রাজা বীরেন্দ্র কুমার-রায় চৌধুরী, শ্রীশ-চন্দ্র গুহ, রুক্মিনী কান্ত ঠাকুর প্রমুখের. সাথে মুক্তাগাছার. নিবি'ড় যোগাযোগ ছিল অনেক। মহাশ্মশান খ্যাত কবি কায় কোবাদ. ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পোষ্ট অফিসে চাকরি কালীন সময়ে রচনা করেছিলেন। ১৩১৬. সালে গবেষক যোগেন্দ্র প্রসাদ দত্ত রচনা করেছিলেন জীবনীগ্রন্থ রাজা জগৎকিশোর।
মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির স্থাপত্য আজও তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বজায় রেখেছে, যা ময়মনসিংহের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।
জমিদার বাড়ির শেষের দিকে একটি ছোট পুকুর ছিল, যা এখন প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীরের কাছে বিশালাকার একটি সিংহ দরজা রয়েছে। জমিদার বাড়ির কিছু অংশ এখন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প, সাব রেজিস্ট্রি অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নবারুণ বিদ্যাইনিকেতন ইত্যাদি।
রাজবাড়িতে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেমন বিষ্ণু সাগর পুকুর, যুগল মন্দির, চাঁন খাঁর মসজিদ, বিবির ঘর, ঘূর্ণায়মান নাট্য মঞ্চ, সাত ঘাটের পুকুর, জলটং, রসুলপুর বন ইত্যাদি। আজও ৩০০ বছরের পুরনো এই জমিদার বাড়ি ভগ্নপ্রায় হলেও, পর্যটকদের আনাগোনায় এটি এখনো জমজমাট থাকে।
★মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি যাবেন কিভাবে?
ময়মনসিংহ—টাঙ্গাইলগামী বাসে চড়ে মাত্র ২০-৩০ টাকা ভাড়ায় খুব সহজেই মুক্তাগাছা পৌঁছাতে পারেন। আপনি সিএনজি রিজার্ভ করেও যেতে পারেন অথবা লোকাল সিএনজিতে করে রাজবাড়িতে পৌঁছানো সম্ভব। ময়মনসিংহ থেকে মুক্তাগাছার দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার, এবং পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৪০-৫০ মিনিট। মুক্তাগাছায় পৌঁছানোর পর আপনি হেঁটে বা রিকশায় চড়ে বাজারের ভেতর দিয়ে জমিদার বাড়িতে যেতে পারেন।
★জমিদার বাড়িতে গেলে কোথায় থাকবেন ও খাবেন।
মুক্তাগাছায় বেশ কিছু এলাকায় আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া, ময়মনসিংহ শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে আপনার পছন্দ অনুযায়ী একটি বেছে নিতে পারেন। ময়মনসিংহের জনপ্রিয় হোটেলগুলির মধ্যে আমির ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল মুস্তাফিজ এবং সিলভার ক্যাসেল রয়েছে, যেগুলিতে আপনি ভরসা রাখতে পারেন।
★কোথায় খাবেন ও কি খাবেন
মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডা খেতে ভুললে আপনার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থাকবে। রাজবাড়ীর সামনে অবস্থিত গোঁপাল পাল এর ঐতিহ্যবাহী মন্ডার দোকানটি ১৫০ বছরের পুরনো এবং দেশের নানা অঞ্চলের মানুষের কাছে এর সুনাম রয়েছে। মুক্তাগাছাতে একমাত্র এই দোকানেই আপনি আসল ও অকৃত্রিম মন্ডা পাবেন। প্রতি পিস মন্ডার দাম ৩৫ টাকা এবং কেজি প্রতি দাম ৭০০ টাকা।
ভারি খাবার খেতে চাইলে মুক্তাগাছা বাজারের মানসম্মত হোটেলগুলোতে খেতে পারেন। ময়মনসিংহ শহরে খেতে চাইলে প্রেসক্লাব ক্যান্টিনের মোরগ পোলাও একটি জনপ্রিয় খাবার। এছাড়া, ভালো মানের খাবারের জন্য হোটেল ধানসিঁড়ি ও হোটেল সারিন্দা বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়।