
পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রাথমিক দিনগুলোতে মহানবী হজরত মুহাম্মদের (স.) দাওয়াত ছিল নিরলস, অবিশ্রান্ত। কুরাইশী কাফিররা যখন দেখল, কোনো কৌশলই কার্যকর হচ্ছে না, তখন সকলে মিলে পরামর্শ করল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে চালাক এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি উৎবা ইব্ন রাবিয়াকে আঁ-হজরতের নিকট পাঠাবে। তারা মনে করেছিল পার্থিব প্রলোভন দেখালে হয়তোবা মুহাম্মদ (স.) নিজ দাবি ও প্রচেষ্টা ত্যাগ করতে পারেন। তদানুসারে উৎবা একদিন মহানবী হজরত মুহাম্মদের (স.) খেদমতে হাজির হয়ে বলল : ‘ভাতিজা!’ তুমি বংশ মর্যাদা ও নামে আমাদের মধ্যে উত্তম। তা সত্ত্বেও তুমি নিজ গোত্র ও দেশের বুকে বিভেদ সৃষ্টি করছ। আমাদের প্রভুদের গালি দিচ্ছ এবং পিতৃপুরুষদের বোকা বানাচ্ছ।’ ‘তোমার মনের কথা আজ বল, শুনি! কেনই বা এই মহা তোলপাড় করে চলেছো? এই সবের মূলে যদি তোমার মোটা অংকের ধন-দৌলত উদ্দেশ্য হয়, তবে বল আমরা তোমাকে মক্কার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী করে দেই। আর যদি নেতৃত্ব লাভের বাসনা থাকে, তবে তোমাকে সারা কুরাইশদের সর্দার মানতে আমরা প্রস্তুত। তোমার আদেশের একতিলও এদিক-ওদিক কেউ করবে না। আর যদি রাজত্ব চাও, তবে তাও বল, আমরা তোমাকে সানন্দে রাজা বলে স্বীকার করব। কিংবা যদি তোমার কাছে কোনো দৈত্য-দানবের আসর থাকে, যাকে তুমি অহী বলে বেড়াচ্ছ, তবে তাও বল- আমরা দেশের বাছাই করা বৈদ্য-কবিরাজ এনে তার চিকিৎসা করে দেই-।’ হজরত মুহাম্মদ (স.) বললেন : ‘চাচা! আপনার আর কিছু বলার আছে? উৎবা বলল না, যা বলেছি তাই। ভেবে বল- তোমার মনে কি আছে? এখন আমার কথা শুনুন- এই বলে হুজুর (স.) হা’মীম সাজদাহ সূরা তেলাওয়াত শুরু করলেন। অর্থাৎ হা’মীম! একান্ত দয়ালু ও দাতার পক্ষ হতে অবতীর্ণ। জ্ঞানী লোকদের জন্য আরবি ভাষায় কুরআনের আয়াতগুলো সুন্দরভাবে খুলে বিবৃত করা হয়েছে। ইহা মানুষকে সুসংবাদ দেয়, অপকর্মের মন্দ পরিণতি হতে সাবধান করে। তবুও অধিকাংশ লোক কর্ণপাত করে না...।’
নবী কারীম (স.) সুধামৃত ঢেলে চললেন। বৃদ্ধ উৎবা তা শুনে বিমুগ্ধ হয়ে হা করে রইল। কি মিষ্টি, কি মধু যে এর মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধ আজ খুব কাছে বসে তা অনুধাবন করতে পারল। বয়স্ক, দুর্বল, সে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারত না। তাই হাত দু’খানি পিছনে মাটিতে ঠেকিয়ে ভর করে রইল। শুনে তার তৃষ্ণা মিটছিল না। বারবার বলছিল আরও বল আরও বল...।
খোদার পেয়ারা হাবীব (স.) পড়তে পড়তে সিজদার আয়াতে পৌঁছে সিজদা করলেন। তারপর উঠে জিজ্ঞাসা করলেন- আবু ওয়ালীদ (তার উপনাম) এইতো শুনলেন! এখন আপনিই বুঝে দেখুন।’ উৎবা একটি কথাও আর বলল না। সে সোজা উঠে চলে গেল। দূর হতে তাকে দেখে সাথীরা কেউ কেউ বলল, উৎবা কিন্তু পূর্ব মূর্তি নিয়ে আসেনি। তাদের কাছে গিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত মনে এবং গম্ভীর স্বরে সে বলল : আজ যে কথা শুনলাম জীবনে আর কোন দিন এমন কথা শুনিনি। ঐগুলি না কবিতা, না গণকের কথা, আল্লাহর কসম! ঐগুলো জাদুও না।’
পুনরায় তাদের উদ্দেশ করে বলল : আমার মতে তোমরা মুহাম্মদকে উৎপীড়ন করা পরিত্যাগ কর। কেননা, তার এমন মধুর বাণী একদিন না একদিন সমাদৃত হবেই। জগতে সে জয়ী হবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তোমাদের একজন শুভাকাক্সক্ষীরূপে বলছি, আমার কথা রাখ। বেশি না হোক অন্তত: কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখ না! আরবের অন্যরা যদি তাকে পরাভূত করতে পারে তবে তোমরা ফাঁকে বেঁচে গেলে। আর যদি মুহাম্মদই জয়ী হয়, তবে সে আমাদের গোত্রের-কুরাইশী ছেলে। তার জয় আমাদেরই জয়, তার সুনাম, মূলত আমাদেরই সুনাম।’ আজ কুরাইশদের সবচেয়ে ফন্দিবাজ সরদারের মুখে একি কথা! সবাই শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল এবং উৎবাকে মুহাম্মদ (স.) জাদু করেছে বলতে বলতে যে যার পথে চলে গেল। এই অভিনব পন্থায়ও ব্যর্থ হয়ে দুষ্টরা আরও চটে গেল এবং সাহাবাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। এসব অত্যাচারের দিনে আম্মারের মতো জিন্দাদিল আশিকে রাসূল সাহাবী বনী মখযুমের লোকের হাতে নির্দয়ভাবে প্রহৃত হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করলেন। সে কি এক হৃদয়বিদারক ব্যাপার! ইসলামের ইতিহাসে এই নিঃসহায় ক্রীতদাস শহীদ হয়ে ইসলামের বিজয় পতাকা আরও ঊর্ধ্বে উড্ডীয়মান করে গেলেন। যুনায়রা নাম্নী আর এক বৃদ্ধা ক্রীতদাসী পাষ-দের অত্যাচারে অন্ধ হয়ে গেলেন। এমনিভাবে চতুর্দিকে সহায় সম্বলহীন সাহাবাদের দুরবস্থার কথা শুনে হুজুর (স.) বিচলিত হয়ে উঠলেন। মর্মাহত হয়ে তিনি বিষণ্ন মনে প্রায়ই ভাবেন- কি করা যায়? হায়রে সত্যের খাতিরেই আজ তাদের এই অবস্থা! কখনো কখনো মনে করেন যে, অন্যত্র কোথাও হিজরত করে চলে যেতে তাদেরকে বলবেন। তাহলে হয়তো তারা জালিমদের পৈশাচিকতা হতে কোনো রকমে রেহাই পাবে। সেই মহা দুর্যোগ ও সংকটকালে বিভিন্ন আয়াত ও নানা স্বপ্ন হজরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রাণে সাহস জোগায়। হজরত রাসূলে কারীম (স.) উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধে অকাতরে দুঃখ সয়ে যেতে লাগলেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে সঙ্গীবর্গসহ উক্বা ইবনে রাফে- এর ঘরে বসে আছেন; ইবনে তাবের বাগানের প্রচুর খেজুর সঙ্গীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। হজরত মুহাম্মদ (স.) সেই স্বপ্নের তা’বীর করলেন যে দুনিয়াতে মুসলমানদের উন্নতি ও জয় হবে এবং তারা আখিরাতে হবে উত্তম প্রতিদানের অধিকারী।
আলহামদু লিল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। সত্যিই তাই হলো। যতদিন পর্যন্ত মুসলমান জাতি আল কুরআনের পবিত্র শামিয়ানার নিচে অবস্থান করে হাদিসের আলোকধারায় বুক ভরা নবী প্রেম নিয়ে জীবন পরিচালনা করেছে, ততদিন অপ্রতিরোধ্য জয় ও সম্মান-প্রতিপত্তি তাদের পদচুম্বন করেছে। ইসলামের আদর্শ ও মুসলমানদের চরিত্র দেখে মুহিত হয়ে দলে দলে লোক শান্তির পতাকা তলে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে যখনই তারা আদর্শচ্যুত হলো, নবীজী (স.) ও সাহাবা (রা:) গণের ত্যাগ ও মহিমা ভুলে বসে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা কিংবা বিজাতীয় মতবাদে ডুবে গেল, তখনই তারা আক্রান্ত হলো জিললতি ও অপমানে।
আজ মুসলমানরা একদল নেকড়ের সামনে মেষ শাবকের মতো। নবীজীর (স.) মহান সুন্নাহর অনুকরণের মাধ্যমেই এ থেকে মুক্তি সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]
প্যানেল