
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।
দারিদ্র্য, দুর্ভাগ্য, এবং ভাঙা সংসারের ভার—এই সবকিছুকে হার মানিয়ে এক ভূমিহীন কৃষক আজ পরিচিত ‘বীজ সুলতান’ নামে। তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় মাত্র ২ কেজি ধানের বীজ।
নিজের জমি না থাকলেও কৃষক মো. রফিক আহমেদ পরের জমি পত্তন নিয়ে চাষ করেন। আজ কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে ৬ একর জমিতে ধান চাষ করেন। এক সময়কার অশিক্ষিত, নিঃস্ব, পরিত্যক্ত প্রবাসী শ্রমিক রফিক এখন দেশের ৮টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে স্বীকৃত নাম।
২০০৮ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় ধানের বীজ উৎপাদন শুরু করেন। এখন প্রতিবছর তিনি ৩৫০ মণ পর্যন্ত ধানের বীজ উৎপাদন করেন, যা বাংলাদেশের নামি ডিলাররাও প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করেন।
দেশজুড়ে তাঁর পরিচিতি আজ ‘বীজ সুলতান রফিক’ নামে। তার উৎপাদিত বীজ ব্যবহার করে গবেষণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিনা উপকেন্দ্র ও অনেক কৃষি প্রতিষ্ঠান।
রফিক বলেন, "ক্ষুধার যন্ত্রণা আমাকে শিখিয়েছে টিকে থাকার লড়াই। আমি চাই দেশের মানুষের ক্ষুধা নিবারণে কাজ করে যেতে। সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা না পেলেও কৃষি বিভাগ সবসময় পাশে থেকেছে।"
তাঁর সংগ্রহে ব্রি ধান ১০২, ১০৮, এমনকি পরীক্ষাধীন ব্রি ধান ১১৭ পর্যন্ত জাত রয়েছে—যার অনেকগুলোই অন্য কোথাও সংরক্ষিত নেই।
অবাক করা বিষয় হলো, এত গুরুত্বপূর্ণ বীজ তিনি সংরক্ষণ করেন নিজের ঘরের পাশে ইট বিছানো কাঁচা ভিটে, বস্তা ও ড্রামের মধ্যে। তাঁর কোনো আধুনিক সংরক্ষণাগার নেই, নেই সরকারি অনুদান।
কৃষি কর্মকর্তা বানিন রায় বলেন, "রফিক আহমেদ একজন আদর্শ কৃষক। আমরা তাকে বীজ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি। উনি শুধু দেবীদ্বার নয়, পুরো দেশের গর্ব।"
ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্প: ফেনীর সন্তান রফিক ১৯৭৮ সালে জীবিকার খোঁজে আসেন কুমিল্লায়। পরে প্রবাসে গেলেও স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে সংসার ভেঙে যায়। দুই ছেলে নিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন সংগ্রাম। একসময় অভাবে উপোস থেকেছেন, কৃষি উপসহকারী তাজুল ইসলাম তাকে ২ কেজি বীজ দেন, সেখান থেকেই শুরু। আজ তার বড় ছেলে মালদ্বীপ প্রবাসী, দ্বিতীয় ছেলে ডা. নাজির আহমেদ কুমিল্লা মেডিকেলে ডেন্টাল সার্জন হিসেবে কর্মরত।
মাত্র ২ কেজি বীজ বদলে দিয়েছে একজন হতদরিদ্র কৃষকের ভাগ্য। ‘বীজ সুলতান রফিক’ প্রমাণ করেছেন—প্রশিক্ষণ, অধ্যবসায় ও সঠিক সহযোগিতা পেলে কৃষিই হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
মিরাজ খান