ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নে বিভোর সামিউল

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ২ জুলাই ২০২৫

জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নে বিভোর সামিউল

ফুটবলই ধ্যান-জ্ঞান সামিউলের

বাংলাদেশের ফুটবলে এখন নবজোয়ার চলছে। বিশ্বের সেরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী বাংলার সবুজ জমিনে পা রাখার পর থেকেই প্রাণের খেলা ফুটবলে ফিরেছে প্রাণসঞ্চার। সুযোগটা কাজে লাগাতে মরিয়া দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাফুফে। তারা দেশ-বিদেশের প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় ফুটবলারদের পরখ করে দেখা শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রবাসী ফুটবলারদের দিকে এখন পাখির চোখ কর্তাদের। যার অংশ হিসেবে ২৮, ২৯ ও ৩০ জুন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে হয়েছে প্রবাসী তরুণ ফুটবলারদের ট্রায়াল। 
তিনদিনের ট্রায়ালে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ইতালি, সুইডেনসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ৪৯ জন প্রবাসী ফুটবলার অংশ নেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কোচদের সামনে পরীক্ষায় বসেছিলেন টগবগে তরুণেরা। ‘বাফুফে নেক্সট গ্লোবাল স্টার’ নামে এই ট্রায়াল শেষে ফুটবলারদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সার্টিফিকেট। জাতীয় দলে খেলার এই সুযোগটা হারাতে চাননি ইংল্যান্ড প্রবাসী প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ সামিউল ওয়াদুদ। যার ডাক নাম সামি। ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি তার গভীর টান।

খেলতেন প্রায় সব ইভেন্ট। কিন্তু তাকে বেশি টেনেছে গোটা দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। তাইতো পড়ালেখার পাশাপাশি ফুটবল খেলছেন নিয়মিত। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে খেলা সামিউল নিজ যোগ্যতায় খেলতে চান বাংলাদেশ জাতীয় দলে। এ লক্ষ্যেই তিনি ফুটবল ফেডারেশনের ‘বাফুফে নেক্সট গ্লোবাল স্টার’ ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর নিজের যোগ্যতা দিয়ে তিনি স্বপ্নের জাতীয় দলে খেলতে মুখিয়ে আছেন। 
৬৯ ইঞ্চি উচ্চতার সামিউলের বয়সটাই এখন সবকিছু জয় করার। সবে ২২ বছরের তরতাজা তরুণ। এই বয়সেই সবকিছু জয় করার মোক্ষম সময়। সামিউলও তেমনটিই চান। নিজের মেধা, মনন আর পারফরম্যান্স দিয়ে দেশের ফুটবলে অবদান রাখতে চান। জনকণ্ঠের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় সামিউল বলেন, ‘আমি ক্লাস ফোর থেকে ফুটবল খেলা শুরু করি। শুরুতে গোলরক্ষক ছিলাম। একদিন বড় ভাইদের সঙ্গে খেলার সময় আরিফ ভাই আমাকে বলেন, ‘যা সামনে খেলে দেখ।’ ওইদিনের পর কখনো পেছনে ফেরত আসিনি।’

শুরুটা গোলরক্ষক হিসেবে হলেও সময়ের পরিক্রমায় সামিউল এখন লেফট উইং ও মিডফিল্ডার পজিশনে খেলে থাকেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয়। বেশির ভাগ তরুণই ক্রিকেটে আসতে চান। আপনি কেন ফুটবল বেছে নিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে সামিউল বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে খেলা যায় এমন প্রায় সব খেলাই ভালো খেলতে পারি। কিন্তু ফুটবলের মতো অন্য কোনো খেলা আমার মনে জায়গা করতে পারেনি। জীবনে অনেক ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু ফুটবলের মতো শান্তি পায়নি। বলতে পারেন ফুটবল আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। বাংলাদেশে ফুটবল যেন ক্রিকেটকে ছাপিয়ে যেতে এ স্বপ্নই দেখে আসছি।’
সামিউল ইংল্যান্ডে এ-লেভেল শেষ করে পাইলট হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা করতে শতভাগ স্কলারশিপ নিয়ে হাঙ্গেরিতে পড়াশোনা করছেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি ব্রমলি এফসির হয়ে খেলেছেন। সানডে লিগেও খেলেছেন নিয়মিত। বর্তমানে হাঙ্গেরির বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলছেন। বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগেও ভবিষ্যতে খেলার ইচ্ছে আছে। স্প্যানিশ পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদ আর পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর অন্ধভক্ত সামিউল সি আর সেভেনকে আদর্শ হিসেবে মানেন। রোনাল্ডোর সবকিছু ফলো করে এ পর্যন্ত এসেছেন বলে জানান। এ প্রসঙ্গে সামির ভাষ্য, ‘আমি রোনাল্ডোর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁকে দেখেই ফুটবলের প্রতি আমার এই ভালোবাসা। ফুটবলের মাধ্যমে একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
নিজেকে প্রমাণ করতে শতভাগ আত্মবিশ্বাসী সামিউল। তার বিশ্বাস একদিন ঠিকই জাতীয় দলে জায়গা করে নিবেন। বাফুফের ট্রায়ালের পর তিনি বলেন, ‘আমি যতদিন আমার মূল্য প্রমাণ করতে পারব না, ততদিন চেষ্টা করে যাব আমার দেশের হয়ে খেলার জন্য। আমি কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাসী। সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব যদি কেউ সেটার পেছনে লেগে থাকে। আমিও হার মানব না; অর্জন করেই ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ স্বপ্নবাজ সামিউল বলেন, ‘বাফুফের ট্রায়ালে প্রথমে সবারই একটু কষ্ট হয়েছে। কারণ কেউ কাউকে চিনত না, আবহাওয়ার সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারেনি। পরের দিনগুলোতে সবাই ভালো করেছে।

ইনশাআল্লাহ আমি বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাব। আল্লাহ না করুক, যদি এবার না পাই, আমি আবার আসব এবং আসতেই থাকব যতদিন আমি আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে না পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বর্তমানে পাইলট হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা করছি। পাশাপাশি ফুটবল খেলাও চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আমার দেশের জন্য দুটোই করতে চাই। যখন ফুটবলে ডাক আসবে, তখন বিমান সংস্থা থেকে ছুটি নিয়ে মাঠে নেমে যাব দেশের জন্য।’ সবকিছু ঠিকঠাকমতো হলে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলেও নিয়মিত খেলার ইচ্ছে আছে সামিউলের। 
হালের ক্রেজ হামজা চৌধুরী প্রসঙ্গে সামিউল বলেন, ‘হামজা চৌধুরী আসার পর বাংলাদেশের ফুটবলে জনপ্রিয়তা ফিরে এসেছে, যা আমার স্বপ্ন ছিল। দিন শেষে দেশের জন্য মাঠে নামবো এটাই ছিল স্বপ্ন।’ দৃঢ়চেতা সামিউল নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চান। তাইতো দীপ্তকণ্ঠে বলেন, ‘আমি আগামীর হামজা চৌধুরী হতে চাই না; হতে চাই প্রথম সামিউল ওয়াদুদ। মানুষ আমাকে স্বনামে চিনুক এটাই চাই মনেপ্রাণে।’ চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বেড়ে ওঠা সামিউলকে সবাই চিনতেন একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে।

বাবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর ওয়াদুদ। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সামি। খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা ও ফুটবল নিয়েই তার বেড়ে ওঠা। পরিবারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খেলেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিযোগিতায়। অর্জন করেছেন সাফল্য। সামিউলের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তিনি একবেলা খাবার না খেয়েও  থাকতে পারেন কিন্তু ফুটবল ছাড়া থাকতে পারেন না। ফুটবলের প্রতি এই ভালোবাসাই তাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে।

বাবা সামরিক চাকরি থেকে অবসরের পর সামি পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু যার রক্তে ফুটবল সে ফুটবল থেকে দূরে থাকে কি করে? আর ইংল্যান্ড তো ফুটবলের তীর্থস্থান। সামি ইংল্যান্ডেও পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছেন ফুটবল চর্চা। খেলেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। অর্জন করেছেন প্রশংসা। অবশেষে সুযোগ এসেছে লাল-সবুজের জার্সি পরে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার। মাতৃভূমির টানে সামিউল ছুটে এসেছেন ইংল্যান্ড থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায়। বাফুফের ট্রায়ালে নিজের প্রতিভা দেখিয়ে স্থান করে নিতে চান ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ জাতীয় দলে।

ছেলেকে নিয়ে ভীষণ আশাবাদী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর ওয়াদুদও। তিনি বলেন, ‘ফুটবল সামিউলের আজন্ম প্রেম। তাকে খাওয়া না দিলেও চলবে কিন্তু ফুটবল খেলতে দিতে হবে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন লালন করে আসছে সেই শৈশব থেকে। বাবা হিসেবে একটা লুকানো স্বপ্ন আমারও ছিল। গ্যালারিতে বসে ছেলের খেলা দেখে হাততালি দিব। আর সেটা যদি হয় নিজের দেশের হয়ে তাহলে তো কথাই নেই। আমিও চাই ছেলেকে ফুটবলার হিসেবে দেখতে। সুযোগটা আজ অনেক কাছে।

লাল-সবুজের জার্সির টানে, দেশের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন নিয়ে আমার ছেলে লন্ডন থেকে ছুটে এসেছে ঢাকা। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিভাবান ফুটবলারদের বাফুফে নির্বাচন করে জড়ো করেছে ঢাকায় জাতীয় স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায়। ছেলের স্বপ্নপূরণের এই যাত্রায় সবার দোয়া চাই।’
তবে বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন এই প্রবাসী তরুণদের পূরণ হবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। কেননা ট্রায়ালের পর বাফুফে এখন পর্যন্ত কাউকে ‘সবুজ সংকেত’ দেয়নি। সবার পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রবাসীদের ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বাংলাদেশ দলে খেলার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ ফুটবলাররা জড়ো হয়েছিলেন। অনেক ফুটবলারের সঙ্গে তাদের বাবা-মাও এসেছিলেন। তিন দিনের ট্রায়াল শেষে অনেক ফুটবলারই হয়তো আবার ইউরোপ, আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। অপেক্ষায় থাকবেন কখন সুখবর আসে সেই আশায়। সামিউলও সেই সুখবরের আশায় পথ চেয়ে আছেন।

×