
মোসাদ্দেক-সৈকতের মতো জাতীয় দলে জায়গা হচ্ছে না টপঅর্ডার ব্যাটার সৌম্য সরকারেরও
‘আপনি আপনার সাংবাদিকতার আলোকে মনে করছেন যে মোসাদ্দেক হোসেনের এই মুহূর্তে জাতীয় দলে খেলা উচিত। আমি ঠিক সেই জিনিসটা মনে করছি না। পরিষ্কারভাবে বলতে চাচ্ছি, কারণ যতক্ষণ মেহেদী হাসান মিরাজ আছে, মোসাদ্দেকের কোনো সুযোগ নেই। খুব কোনো জিনিস খুব স্পষ্টভাবে হওয়া উচিত। জাস্ট আপনারা বুঝে অনেক সময় না বোঝার ভান করে কথা বলেন অনেক সময়, এটা পীড়াদায়ক।’ হোম অব ক্রিকেট মিরপুরে শ্রীলঙ্কা সফরের ওয়ানেড দল ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু।
যেন সাংবাদিক অন্যায় করে ফেলেছেন! ১৬ ম্যাচে ৪.০৪ ইকোনমি রেটে সর্বোচ্চ ৩০ উইকেট নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ১৪ ইনিংসে ৪৮.৭০ গড় ও ১০৬.৩৩ স্ট্রাইক রেটে করেন ৪৮৭ রান। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী চ্যাম্পিয়নই হয়েছে তার কাঁধে চেপে। এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের পরও তাকে দলে না নেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়ে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেললেন প্রাধান নির্বাচক! একজন প্রধান নির্বাচক, সাবেক অধিনায়ক যদি এভাবে মেজাজ হারান, তবে দেশের ক্রিকেটের মেজাজ ঠিক থাকে কী করে!
অপরদিকে, নুরুল হাসান সোহান করেছেন ৫২২ রান, গড় ৫৮, করেছেন দুটি শতক ও দুটি অর্ধশতক। প্রধান নির্বাচক জানিয়েছেন লিটন দাস টি২০ অধিনায়ক, তাকে খেলার মধ্যে রাখতেই সোহানকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি! ‘সোহান অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় আছে। তবে দলে একাধিক উইকেটরক্ষক রাখার জায়গা নেই। লিটন এখন টি২০ অধিনায়ক এবং পরবর্তী বিশ্বকাপ পর্যন্ত তার জায়গা ধরে রাখার পরিকল্পনা আছে। সেই ধারাবাহিকতা তৈরির অংশ হিসেবেই আমরা চাইছি ও যেন ওয়ানডে খেলতে পারে।’
এইসব ব্যাখ্যা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মধ্যেও। ক্রিকেটাররা যদি ঘরোয়া পারফরম্যান্স দিয়েও দলে ঢোকার সুযোগ না পান, বরং ‘তারকা’ ক্রিকেটারদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে সেটা নির্বাচনি নীতির ভারসাম্য কতটা বজায় রাখছে? বাংলাদেশ এক সময়ের ওয়ানডে সুপারস্পেশালিস্ট দল। যে ফরম্যাটেও এক যুগ আগেও যাদের ছন্দ ছিল চোখে পড়ার মতো- সেই দল এখন ছন্দহীন, কাঠামোবিহীন ও আত্মবিশ্বাসহীন। শ্রীলঙ্কা সিরিজটা হয়ে উঠেছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
বর্তমান বাংলাদেশ ওয়ানডে দল তিনটি মূল দিক-ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংÑতিনটিতেই দৃশ্যত অফফর্মে আছে। ওয়ানডে ফরম্যাটে যেখানে ধারাবাহিকতা এবং পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি, সেখানে বারবার দলীয় ব্যর্থতা কেবল হারের কারণই নয়, আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরার কারণ হয়ে উঠেছে। উইকেট স্পিনিং হোক বা স্পোর্টিং-বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ এখন কোনো অবস্থাতেই নির্ভরযোগ্য নয়। উদ্বোধনী জুটি নিয়ে স্থায়ী সমাধান এখনো মেলেনি, মিডল অর্ডারে অভিজ্ঞতা থাকলেও নেই ম্যাচ জেতানো সক্ষমতা। তরুণ যারা সুযোগ পাচ্ছে, তারাও প্রতিভার আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারছে না।
ম্যাচের মোড় ঘোরানো বাংলাদেশ এখন স্পিনিং কন্ডিশনেও তেমন সুবিধা করতে পারছে না। পেস বিভাগেও ধারাবাহিকতার অভাব প্রকট। তাসকিন- মুস্তাফিজুরের পর নতুন নতুন বোলার এলেও কেউই নিজের জায়গা পাকা করতে পারছে না। পেস-স্পিনের সমন্বয়, উইকেট টেকিং বোলার, ডেথ ওভারে দক্ষতাÑসবই প্রশ্নবিদ্ধ। আধুনিক ক্রিকেটে ফিল্ডিং একটি বড় পার্থক্য তৈরি করে, আর সেখানেই বাংলাদেশ দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। সহজ ক্যাচ ছাড়া, রান আউট মিস, ফিল্ডিংয়ে মনোযোগের ঘাটতি ম্যাচ ঘোরাতে ব্যর্থ করছে দলকে।
বাংলাদেশ এখন একটি তরুণ দল, তবে সেই তরুণ দল কীভাবে তৈরি হলো সেটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। খেলোয়াড়দের হঠাৎ বাদ দেওয়া, ঘন ঘন স্কোয়াড পরিবর্তন, ম্যাচ টু ম্যাচে নতুন মুখ যোগ করার প্রবণতা দলকে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে না বরং আরও দুর্বল করছে। যে খেলোয়াড়রা দলে থাকছে, তাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুপস্থিত। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন এক অস্থির সময় পার করছে। দল হারছে, ধারাবাহিকতা নেই, আর মাঠের বাইরে তৈরি হচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন।
এর মাঝে সবচেয়ে বড় প্রশ্নÑঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভালো করা খেলোয়াড়রা বারবার উপেক্ষিত হচ্ছেন কেন? সোহান, সৈকতের মতো পারফরমাররা দীর্ঘদিন ধরে ঘরোয়া এবং কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচেও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। বিশেষ করে সোহান উইকেটরক্ষক হিসেবে ধারাবাহিক, নেতৃত্বগুণসম্পন্ন এবং লোয়ার অর্ডারে কার্যকর ব্যাটসম্যান হিসেবেও বিবেচিত। সৈকত একজন কার্যকর অলরাউন্ডার, যিনি দলের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এদের জায়গা হচ্ছে না মূল দলে, এমনকি স্কোয়াডেও! তাই সোহান বা সৈকতের মতো ক্রিকেটারদের উপেক্ষা করা মানে শুধু একজন প্লেয়ারকে নয়, একটি বিকল্পকে হারানো।
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য খেলোয়াড়রা যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচক কমিটি। পরিকল্পনার অভাব, ঘনঘন একাদশ পরিবর্তন, তরুণদের নিয়ে পরিষ্কার রোডম্যাপের অভাব, সব মিলিয়ে দলের ভেতরেই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এমনকি প্রশ্ন উঠছে, কেন বাংলাদেশ নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে পারছে না? ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফর্ম করা অনেকেই জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছে না, অথবা পেয়েও পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে না নিজেদের মেলে ধরার। ‘ট্যালেন্টের অভাব’ বলা যতটা সহজ, তার চেয়ে বেশি দায়ী ব্যবস্থাপনাগত দৈন্য। সবকিছু মিলিয়ে একটি অস্পষ্ট ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে দলটি।
উন্নত ক্রিকেট সংস্কৃতিতে যেখানে একটি সুসংহত সিস্টেম তরুণদের গড়ে তোলে, বাংলাদেশ সেখানে হাঁটছে দিন-মাফিক পরিকল্পনায়। প্রতিবারই ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কর্তারা বলেন, পারফরম্যান্সই একমাত্র মানদ-। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঘরোয়া আসরে ধারাবাহিক পারফরমারদের বদলে এমন কিছু খেলোয়াড় বারবার সুযোগ পাচ্ছেন যারা আন্তর্জাতিক ম্যাচে বারবার ব্যর্থ হয়েও দলে থাকছেন শুধু পরিচিতি বা ‘পটেনশিয়াল’-এর ওপর ভর করে। এই প্রবণতা কেবল প্রতিভার অপচয় নয়, দলের ভবিষ্যতের জন্যও ক্ষতিকর। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক স্বপ্ন হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সাবস্টিটিউট তৈরির রীতিমতো অভাব। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি আফগানিস্তানও এখন এমন দল তৈরি করছে যেখানে একজন খেলোয়াড় ইনজুরি বা অফফর্মে থাকলে সহজেই তার বিকল্প তৈরি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এমন পর্যাপ্ত বিকল্প নেই। কেউ বাদ পড়লে একেবারে হঠাৎ নতুন মুখ এনে মাঠে নামানো হয়Ñযার ফলে না সে মানসিকভাবে প্রস্তুত, না দল তার ওপর আস্থা রাখতে পারে। ক্রিকেটে ‘ব্যাকআপ’ শব্দটি শুধুই কাগজে আছে, বাস্তবে কার্যকর নয়।
দলে জায়গা পাওয়ার মানদ- কি এখনো স্পষ্ট? প্রশ্নটা এখানেইÑজাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার মানদ- কী? যদি ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করেও দলে জায়গা না হয়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে খেলোয়াড় বাছাই হচ্ছে? নির্বাচকদের বিবেচনা কি শুধু পরিচিত মুখ, সামাজিক চাপ, কিংবা একান্ত পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভরশীল? এই অনিশ্চয়তা তরুণ ও অভিজ্ঞ, উভয় প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি করছে, যা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি।