ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

ডলারের পতন ও ইউরোপের শক্তি বৃদ্ধি: বিশ্বের আর্থিক ভূরাজনীতির নতুন মোড় নিচ্ছে

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ২ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০২:১১, ২ জুলাই ২০২৫

ডলারের পতন ও ইউরোপের শক্তি বৃদ্ধি: বিশ্বের আর্থিক ভূরাজনীতির নতুন মোড় নিচ্ছে

বিশ্ববাজারে ডলারের দাম ২৬ জুন, বৃহস্পতিবার, সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান এতটাই দুর্বল হয়েছে যে, ২০২১ সালের পর এই প্রথম এমন দর দেখা গেছে। শুধু ইউরো নয়, পাউন্ড, ইয়েন, এমনকি সুইস ফ্রাঙ্কের বিপরীতেও দুর্বল হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রাটি। কিন্তু কেন এমন পতন ঘটছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির পর বিশ্ব অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরলেও, আমেরিকার মুদ্রানীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক অনিশ্চয়তা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এক অদ্ভুত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—হোয়াইট হাউস বনাম ফেডারেল রিজার্ভ। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের প্রতি এই অনিশ্চয়তা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি ফেড চেয়ারম্যান জেরোনম পাওয়েলকে 'গড়কর্তা' বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তার বদলে নতুন কাউকে বসানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলে, প্রশ্ন উঠছে—ফেড কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে?

এই সন্দেহটাই বড় বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করেছে। যদি ফেড রাজনৈতিক চাপে পড়ে, তাহলে সুদের হার ও মুদ্রানীতি নিয়ে বাজার আর নিশ্চিত থাকবে না। এই অনিশ্চয়তা ডলারের উপর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

ডলারের শক্তি হারানোর কারণ

বর্তমানে ইউরোর বিপরীতে ডলারের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ১.১৬৮৭ শতাংশ, যা বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী ১.১৯০৯ পর্যন্ত উঠতে পারে। পাউন্ড শক্তিশালী হয়ে ১.৩৬৯০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা ২০২২ সালের পর সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, সুইস ফ্রাঙ্কের বিপরীতে ডলারের মান ০.৮৩৩৩ শতাংশ কমে গেছে, যা ২০১১ সালের পর সর্বনিম্ন। ডলার ইনডেক্সও নেমে গেছে ৯৭.৪৯১-এ, যা ২০২২ সালের শুরুর পর সর্বনিম্ন।

বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটাই প্রশ্ন উঠছে—ফেড কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে? ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও চাচ্ছেন ফেডের বর্তমান চেয়ারম্যান জেরোনম পাওয়েলকে সরিয়ে দিতে। এমনকি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে তার বদলি ঘোষণা আসতে পারে। ট্রাম্পের অভিযোগ, পাওয়েল সুদের হার যথেষ্ট কমাননি, আর তাই তিনি গড়কর্তার মেধার অধিকারী।

পাল্টা জবাবে পাওয়েল বলেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এই টানাপোড়েনে বিনিয়োগকারীরা খেই হারিয়ে ফেলছেন। একদিকে যুদ্ধ থামছে, অন্যদিকে মার্কিন অর্থনীতি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়ছে।

বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ এবং ইউরোপের শক্তি বৃদ্ধি

বিশ্ববাজারের বিশ্লেষকরা এখন অনুমান করছেন, জুলাইয়ের বৈঠকে ফেড সুদের হার কমাতে পারে। আগে ১২ শতাংশ সম্ভাবনা থাকলেও এখন তা ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া, বছরের শেষ নাগাদ ৬৪ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত হার কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাজার। জেপি মরগান সতর্ক করে বলেছে, শুল্কের কারণে আমেরিকায় প্রবৃদ্ধি কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং মন্দার ঝুঁকি ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিচ্ছে ইউরোপ। কারণ ইউরোপের দেশগুলো যৌথভাবে প্রতিরক্ষা ও অবকাঠামোতে বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ইউরোপীয় অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ভিত্তি দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ডলারের এই পতন শুধু বাজারের স্বাভাবিক ওঠানামা নয়। এর পেছনে রয়েছে আমেরিকার কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণী স্তরে আস্থাহীনতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রশ্ন।

বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের উপর বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস যদি চিরস্থায়ী না থাকে, তবে সামনে আর্থিক ভূরাজনীতি এক নতুন মোড় নিতে পারে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে ট্রাম্প বনাম ফেরদণড।

 

রাজু

×