
ছবি: Surge Bangladesh
মানবাধিকার মানে শুধু বইয়ের বুলি নয়—এটা জীবনের গভীরে গাঁথা এক অনুভব, এক দায়িত্ব। এই উপলব্ধিটা যেন একেবারে মজ্জাগত হয়ে গেল এই দু’দিনের Human Rights Orientation সেশনে অংশ নিয়ে। আমাদের চারপাশে যখন প্রতিনিয়ত অধিকার হরণ, বৈষম্য আর ন্যায়ের অভাব চোখে পড়ে, তখন এই প্রোগ্রাম যেন এক নতুন আশার আলো দেখাল।
গত ২৯ ও ৩০ জুন ২০২৫ (রবিবার ও সোমবার) ঢাকার শাহীনবাগের এম্পায়েরিয়ান হোটেলে Human Rights Orientation Session এর আয়োজন করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ (NHRC), UNDP Bangladesh এবং Surge Bangladesh। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ৮২৮ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে দুই ধাপে বাছাই প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচিত ৪০ জনের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।
আমরা অনেকেই মানবাধিকার শব্দটা শুনি, কিন্তু এটা ঠিক কী, কার দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা, আর মানবাধিকার লঙ্ঘণ হলে কোথায় গেলে সহায়তা মিলবে—তা জানার সুযোগ অনেকেরই হয় না। এই দু'দিনের সেশনে ঠিক এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই কাটল সময়।
প্রথম দিন: জানার আনন্দ আর অনুভবের শুরু
২৯ জুন সকাল ৮টায় রেজিস্ট্রেশন দিয়ে শুরু হয় দিন। উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য রাখেন:
মাহমুদুল হাসান, প্রকল্প ব্যবস্থাপক, SIPS Project, UNDP Bangladesh
কাজী আরফান আশিক, পরিচালক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
সেবাষ্টিন রেমা, সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
উদ্বোধনের পরপরই শুরু হয় এক মজাদার সেশন—"আইস ব্রেকিং এক্টিভিটি"। স্পিকার অ্যাডভোকেট জনাব নিয়ামত উল্লাহ গালিব হঠাৎ সবাইকে বললেন, "আপনার ডাকনামের প্রথম অক্ষর দিয়ে নিজের একটি গুণ বলুন!" ৪০ জন অংশগ্রহণকারী মুহূর্তেই নিজেদের বিশেষত্ব তুলে ধরলেন। যেন অচেনা মুখগুলোও তখন আপন হয়ে গেল।
এরপর শুরু হয় মূল মানবাধিকার বিষয়ক আলোচনা। জনাব নিয়ামত উল্লাহ গালিব মানবাধিকারের সংজ্ঞা, ইতিহাস এবং বাংলাদেশের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে দারুণভাবে আলোচনা করেন। ছোটবেলা থেকে আমরা শিখেছি মানুষের মৌলিক চাহিদা ৫টি—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। কিন্তু এখানে আরও জানতে পারি, বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার রয়েছে ১৮টি। এবং এই অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে যেকোনো নাগরিক আইনি সহায়তা চাইতে পারে।
পরবর্তী সেশনটি ছিল "হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার" নিয়ে। জনাব মোহাম্মদ গাজি সালাউদ্দিন, উপপরিচালক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানালেন—মানবাধিকার রক্ষার কাজ করতে হলে নির্দিষ্ট কোনো শর্ত লাগে না। যে কেউ হতে পারে হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার—শুধু থাকতে হবে সচেতনতা আর সাহস। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন—"অপরাধ আর মানবাধিকার লঙ্ঘন এক নয়। অপরাধ দেশভেদে বদলায়, কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন সব দেশে একইভাবে দণ্ডনীয়।"
এরপর জনাব এমডি আব্দুল কাইয়ুম, প্রধান, যোগাযোগ বিভাগ, UNDP আমাদের সবাইকে চারটি দলে বিভাজন করে নাটক উপস্থাপনা করতে বলেন। বিষয় ছিল—ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে আমরা মানবাধিকার রক্ষার কাজ করতে পারি। নাটকগুলো ছিল প্রাণবন্ত। অনেকেই নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় অভিনয় করে আনন্দ বাড়িয়ে দেন।
সেই দিনটিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সেশন নেন জনাব লুবনা ইয়াসিন, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, UNDP Bangladesh। তিনি নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, বয়স্কদের এবং আমাদের আশেপাশে আরও যারা আছেন তাদের অধিকারগুলো নিয়ে কথা বলেন। এইভাবেই নাটক, হাসি-ঠাট্টা, আলোচনায় পরিপূর্ণ ছিল আমাদের প্রথম দিন।
দ্বিতীয় দিন: ভাবনার গভীরে ডুব
৩০ জুন সকালেও রেজিস্ট্রেশন এবং এরপর প্রথম দিনের রিক্যাপ দিয়ে শুরু হয়। এরপর জনাব এম রবিউল ইসলাম, উপপরিচালক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিষয়ে বলেন। আমরা জানলাম—এই প্রতিষ্ঠান কবে গঠিত হয়, কী কী দায়িত্ব পালন করে, কীভাবে অভিযোগ নেয়। এরপর আসে সময় ডিজিটাল অধিকার নিয়ে ভাবার।
জনাব মিনহাজ আমান, রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর, Digitally Right আমাদের জানালেন, ইন্টারনেটের যুগে ডিজিটাল রাইটস জানা না থাকলে জীবনের অনেক দরজা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং আমরা কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি এবং আমাদের করণীয় কি।
আরও একটি সেশন আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
জনাব এমডি নাজমুস সাকিব, ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন অফিসার, UNDP Bangladesh জানালেন, আমরা যারা ভিন্নভাবে সক্ষম (দৃষ্টি, বাক, বা চলনক্ষমতায় সীমাবদ্ধ) মানুষদের শুধু সহানুভূতির চোখে দেখি, সেটা অনেক সময় তাঁদের অসম্মান করার নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। তার কথা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়।
সবশেষে ছিল পোস্টার প্রেজেন্টেশন। আমাদের ৫টি দলে ভাগ করে ৫টি কেস স্টাডি দেওয়া হয়। কোনটি অপরাধ, কোনটি মানবাধিকার লঙ্ঘন আর আমাদের করণীয় কী—সেটা পোস্টার তৈরি করে উপস্থাপন করতে হয়। এই অংশটি পরিচালনা করেন জনাব মোহাম্মদ গাজী সালাউদ্দিন এবং জনাব লুবনা ইয়াসিন।
শেষে জনাব মাহমুদুল হাসান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। জনাব সেবাষ্টিন রেমা পুরো প্রোগ্রামের সারাংশ তুলে ধরেন, আমাদের সকলের প্রশংসা করেন এবং সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে সার্টিফিকেট বিতরণ করেন।
এই দুইদিন শুধু একটি কর্মশালা ছিল না—এটা ছিল ভাবনার গভীরে ডুব দেওয়া, নিজেকে নতুনভাবে চেনা আর সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্ব বুঝে ওঠার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
এই প্রোগ্রাম থেকে পাওয়া জ্ঞান আমার মতো অনেক তরুণের জন্য জীবনের পথচলায় আলোর দিশা দেখাবে, এই বিশ্বাস নিয়েই ফিরে এসেছি।
নোভা