
ছবি: সংগৃহীত
উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি গ্রামে ছয় বছর বয়সী বেদাসের কোনো স্কুল নেই, নেই ক্লাস, সিলেবাস, পরীক্ষা বা রিপোর্ট কার্ড। গরিমা ও আদিত্য তাকে বড় করছেন ‘আনস্কুলিং’ নামে এক বিকল্প শিক্ষাদর্শনে। তারা বিশ্বাস করেন, শিক্ষা মানেই শুধু স্কুলে গিয়ে বই মুখস্থ করা নয়, বরং শিশুর মধ্যে থাকা কৌতূহলকে অনুসরণ করাই আসল শেখা।
আদিত্য এক সময় ছিলেন সিঙ্গাপুরে নাইকি ব্র্যান্ডের সফল ব্যবস্থাপক। স্ত্রী গরিমাও ছিলেন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার। কিন্তু শহুরে জীবনের গণ্ডি, কৃত্রিমতা ও ব্যস্ততায় তারা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাই সন্তান জন্মের সময় তারা ভাবতে শুরু করেন—এই পৃথিবীতে তাদের সন্তান কীভাবে শিখবে, কোন পরিবেশে বেড়ে উঠবে?
এই দম্পতি ‘স্বরাজ ইউনিভার্সিটি’র মতো বিকল্প শিক্ষাদান কেন্দ্র ঘুরে দেখেন, যেখানে শেখা হয় প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে। পরে সিঙ্গাপুরে একটি ফিনান্সিয়াল পরিকল্পনা করে দেখেন, শহরের খরচ বাদ দিলে তারা ৪-৫ বছর অনায়াসে গ্রামে টিকে থাকতে পারবেন। অবশেষে তারা পাড়ি জমান উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি গ্রামে।
বেদাসের প্রতিদিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে। সে কখনো গাছ চড়ে, কখনো পোকামাকড় পর্যবেক্ষণ করে, কখনো পাথর দিয়ে মন্দির বানায়। একবার নিজের জন্মদিনে কতজন অতিথির জন্য কতটি লাড্ডু লাগবে, তা নিজেই গুণ করে বের করেছে—কেউ তাকে গুণনের নিয়ম শেখায়নি।
আদিত্য ও গরিমা বলেন, “আমাদের সন্তান শেখে প্রয়োজন থেকে—not instruction, but inspiration.” তারা মনে করেন, শিশুদের শেখাতে গেলে আগে অভিভাবকদেরই নিজস্ব কাঠামো থেকে ‘আনলার্ন’ করতে হয়।
তারা স্বীকার করেন, এই জীবনধারার পেছনে সিঙ্গাপুরের সঞ্চয় ভূমিকা রেখেছে। তবে এখন তারা খুবই সাশ্রয়ী জীবনযাপন করেন। তাদের আসল সম্পদ হলো—সময়, সংযোগ ও মানসিক শান্তি।
এই দম্পতি একা নন। মুম্বাইয়ের রচিত গাঙ্গার, বেঙ্গালুরুর ‘আরোহী লার্নিং কমিউনিটি’র মতো আরও অনেকেই স্কুল-বহির্ভূত শিক্ষা চর্চা করছেন। কেউ সন্তানদের সঙ্গে বাগানে দিন কাটাচ্ছেন, কেউ শেখাচ্ছেন সংস্কৃত—কোনো পরীক্ষার চাপ ছাড়াই।
‘আনস্কুলিং’ বা স্কুল-বহির্ভূত শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন, অনেক শিক্ষাবিদ এখনো মনে করেন যে, স্কুল শিশুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ।
মুম্বাইয়ের বিখ্যাত বম্বে স্কটিশ স্কুলের প্রিন্সিপাল সুনিতা জর্জ এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে— “স্কুল মানে কেবল ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান শেখা নয়। এখানে শিশুরা শেখে কিভাবে সহানুভূতিশীল হতে হয়, কিভাবে সহ্য করতে হয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিভাবে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হয়।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, আজকের দিনে অধিকাংশ পরিবারেই সন্তান একা বড় হয়, এক ভাই বা বোনও নেই। ফলে ঘরের বাইরে শিশুদের জন্য একটি সামাজিক পরিসর খুবই জরুরি, যেখানে তারা সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে পারে, খেলতে পারে, মতবিরোধ সামাল দিতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে শিখে।
তিনি আরও বলেন, “স্কুল মানে শুধু বই পড়া নয়। এটা একটা ছোট সমাজের মতো—যেখানে শিশুদের মানসিকতা, আবেগ, আচরণ, এবং সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতা তৈরি হয়।”
তার মতে, গুরুকুল বা প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল একটা কাঠামোবদ্ধ সামাজিক শেখার জায়গা, যেখানে শিক্ষার্থীরা গুরুদের তত্ত্বাবধানে থাকত, নিয়ম শিখত এবং বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত হতো।
মুমু ২