
ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসকের পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়কর প্রতিভা—তিনি ডা. এস. এম. বজলুল হক, যিনি যাদুর জগতে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন ‘যাদু সম্রাট শাহ্ মনি’ নামে। যাদুশিল্প, অভিনয়, চিকিৎসা এবং সমাজসেবার এক দুর্লভ সমন্বয়ে গড়া ছিল তার জীবনচিত্র। জন্ম ১৯৪২ সালের ১৩ ডিসেম্বর, জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, পরাগলিতে।
পিতামহসুলভ অনুপ্রেরণায় শিশুকাল থেকেই বিজ্ঞান আর কৌতূহলের প্রতি টান, আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে প্রথম যাদুর জগতে প্রবেশ। এরপর বগুড়া জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করে হয়ে উঠলেন একজন পেশাদার চিকিৎসক। কিন্তু ততদিনে তিনি এক ভিন্ন মঞ্চের নায়ক—যাদু মঞ্চেও নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন।
১৯৭২ সালেই যাদুশিল্পে আত্মপ্রকাশ করে দ্রুতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নেন। ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের মঞ্চে তার যাদুবিদ্যার প্রদর্শনী মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৯৮৫ সালের সর্বভারতীয় যাদু উৎসব, যেখানে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের ৬০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ‘সেরা যাদুকর’ নির্বাচিত হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এই প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিলেন ভারতের যাদু গুরু সংকরদাশ—স্বয়ং যাদু সম্রাট পি.সি. সরকারের শিষ্য।
শুধু মঞ্চের যাদু নয়—শাহ্ মনি ছিলেন সংগঠক হিসেবেও এক অনন্য নাম। এশিয়ান ম্যাজিক সোসাইটি, ম্যাজিক ইন্টারন্যাশনাল এবং বাংলাদেশ যাদুকর পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ছিলেন মডার্ন ম্যাজিক একাডেমির অধ্যক্ষ এবং ওয়ার্ল্ড ম্যাজিক সোসাইটির মহাসচিব। তিনি আমেরিকান সংগঠন I.B.M (International Brotherhood of Magicians)-এর বাংলাদেশ শাখা ‘রিং-২৭৯’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
তার যাদুবিদ্যার সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসে ১৯৮৯ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়াগোতে আয়োজিত ৬১তম বিশ্ব যাদু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সপ্তম স্থান অর্জনের মধ্য দিয়ে—বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক সাফল্য।
পরের বছর, ১৯৯০ সালে সেন্ট লুইসে অনুষ্ঠেয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমেরিকায় যান শাহ্ মনি। কিন্তু ভাগ্য নির্মমভাবে থামিয়ে দেয় তার যাত্রা। ২ জুলাই, নিউইয়র্কে আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৪৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই বিস্ময় মানুষটি।
যাদু আর চিকিৎসার পাশাপাশি সমাজসেবাতেও ছিল তার নিবেদিত মনোযোগ। ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন হক নার্সিং হোম, ঢাকা মেটারনিটি, আজিমপুর ক্লিনিক এবং মৌসুমী ক্লিনিক। প্রকাশিত করেছেন চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী। এমনকি দুইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও অংশ নিয়েছেন।
ডা. শাহ্ মনির জীবন ছিল বহুপ্রতিভার দীপ্ত নিদর্শন। তাঁর অকালপ্রয়াণে থেমে গেছে এক বিস্ময়মানবের যাত্রা, কিন্তু আজো তিনি রয়ে গেছেন যাদুপ্রেমীদের হৃদয়ে, প্রেরণার এক অনন্য প্রতীক হয়ে।
আবির