ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

পর্যটকদের টানে নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ৩ জুলাই ২০২৫

পর্যটকদের টানে নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি

ছবি: জনকণ্ঠ

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর স্মৃতিবিজড়িত লাকসামের ঐতিহাসিক নবাববাড়ি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই দৃষ্টিনন্দন জমিদারবাড়িটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর আগমনে জমজমাট হয়ে উঠেছে এলাকা। তবে পর্যটন সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাড়িটির সংস্কার ও উন্নয়নে নেই দৃশ্যমান অগ্রগতি।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও নির্মাণ কাহিনি

নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে কুমিল্লার লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিয়ের পর স্বামীর আরেকটি স্ত্রী থাকার খবর জানতে পেরে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এই নারী পৃথক থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং তার কাবিনের ১ লাখ ১ টাকা দিয়ে সাড়ে ৩ একর জমিতে ১৮৭১ সালে এই দোতলা বাড়িটি নির্মাণ করেন। নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর। চুন, সুরকি, রড, পাথর এবং ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই বাড়িতে রয়েছে বৈঠকখানা, রংমহল, পুকুর, ঈদগাহ, ১০ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ এবং পারিবারিক কবরস্থান।

১৮৮৫ সালে মাতুল সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাওয়ার পর তিনি জমিদারির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন। নারীশিক্ষা, জনকল্যাণ, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সমাজ সংস্কারে তিনি রেখেছেন অনন্য অবদান। কুমিল্লায় ‘ফয়জুন্নেছা জানানা হাসপাতাল’, হজযাত্রীদের জন্য মক্কায় মুসাফিরখানা, একাধিক স্কুল, এতিমখানা, সড়ক নির্মাণ প্রভৃতি কর্মে তিনি ছিলেন অগ্রণী। এসব অবদানের জন্য ২০০৪ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।

জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তর

২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর নবাববাড়িটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে বাড়ির চারটি কক্ষে সংরক্ষিত আছে নবাব ফয়জুন্নেছার ব্যবহৃত আয়না, খাট, ডাইনিং টেবিল, আরামকেদারা, ঘড়ি, পানের বাটা, সিরামিক বাসন-কোসনসহ ৭৪টি নিদর্শন। আরও ২০০ নিদর্শন নতুন গ্যালারিতে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।

প্রতিদিন গড়ে ৩০০–৪০০ দর্শনার্থী বাড়িটি ঘুরে দেখেন। শুক্রবার থাকে উপচে পড়া ভিড়। প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা। রংমহলকে রেস্টহাউজ হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে ভিআইপি অতিথি ও পর্যটকদের জন্য, যা এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

৯ কোটি টাকার প্রকল্প থেমে আছে

এই ঐতিহাসিক বাড়িটি রক্ষায় পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৯ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে, যার প্রশাসনিক অনুমোদন প্রায় সম্পন্ন হয়েছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির ৪ একর ৫৩ শতক জমি গেজেটভুক্ত করে প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করে।

কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ প্রকল্পে নেই কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি। প্রশাসনিক কার্যক্রম, বরাদ্দ ছাড় কিংবা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেমে আছে বলে জানা গেছে। এতে হতাশ স্থানীয়রা ও ঐতিহাসিক-সচেতন মহল।

লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউছার হামিদ জনকন্ঠকে বলেন, “নবাব ফয়জুন্নেছা ছিলেন সর্বজনীন ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তার স্মৃতি সংরক্ষণে প্রশাসন সবসময় সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখবে।”
জাদুঘরের সমন্বয়ক সাংবাদিক এমএস দোহা বলেন, “নতুন গ্যালারি ও রেস্টহাউজ প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন কোনো গতি নেই, যা হতাশাজনক।”

নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়িটি কেবল একটি স্থাপত্য নয়, এটি নারী ক্ষমতায়ন, সমাজকল্যাণ এবং ইতিহাসের জীবন্ত প্রতীক। পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হলে এই সম্ভাবনাময় প্রত্নপর্যটন কেন্দ্র থমকে থাকবে কাগজে-কলমেই। ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

শিহাব

×