ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

ফুটপাত হোক পথচারীর

হাবিবুল বাশার সুমন

প্রকাশিত: ১৭:৪৯, ২ জুলাই ২০২৫

ফুটপাত হোক পথচারীর

ফুটপাত পথচারীর- এই কথাটি আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, বইয়ে পড়েছি, আইনেও তার স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় নামলে এই কথাটি যেন এক দুর্লভ কল্পনা বলেই মনে হয়। বাস্তবতা হলো, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি প্রধান সড়কের পাশে ফুটপাত এখন হকার, দোকানদার এবং নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে। কোথাও সাময়িকভাবে, আবার কোথাও দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী দোকান হিসেবেও গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
গুলিস্তান, পল্টন, নিউমার্কেট, মিরপুর, মতিঝিল কিংবা ফার্মগেট যে এলাকাই ধরি না কেন, ফুটপাত এখন পথচারীর নয়, বরং ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এমনকি এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে রিক্সাও ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলে, অথচ একজন সাধারণ মানুষ তার দুই পা ফেলার জন্য জায়গা খুঁজে পায় না। ফুটপাত দখলের এই চিত্র শুধু নাগরিক ভোগান্তির প্রতীক নয়, এটি এক ধরনের নাগরিক অধিকারের হরণও বটে। একজন পথচারী যে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে হাঁটবেন- তা যেন আজ একটি বিলাসিতার নামান্তর। বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ বা শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের জন্য এই পরিস্থিতি রীতিমতো ভয়াবহ। অনেক সময় তাদের বাধ্য হয়ে গাড়ির চলাচলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়, আর এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ছে। নগর কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান চালায়। হকারদের উচ্ছেদ করা হয়, দোকান সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এসব পদক্ষেপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্থায়ী ও লোকদেখানো। কারণ কয়েক দিনের মধ্যেই একই জায়গায় আবার বসে যায় সেই পুরনো দোকান, ফেরত আসে হকাররা। এটি যেন এক চক্রাকার প্রক্রিয়া যেখানে উচ্ছেদ, দখল, পুনরায় উচ্ছেদ চলতেই থাকে। এই পরিস্থিতির জন্য এককভাবে হকারদের দায়ী করাও যুক্তিযুক্ত নয়। ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ, কর্মসংস্থান সংকটময় শহরে বহু মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ফুটপাতে বসে। এই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা। তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। কিন্তু সেই মানবিকতা যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে- এ বিষয়েও আমাদের সংবেদনশীল হতে হবে।সুতরাং এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত পরিকল্পনা। একদিকে যেমন হকারদের জন্য নির্দিষ্ট বিকল্প স্থান নির্ধারণ করতে হবে, তেমনি প্রয়োজন সময়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা (যেমন সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট স্থানে বসতে দেওয়া), কঠোর আইনি ব্যবস্থাপনা এবং পর্যাপ্ত নজরদারি। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা না থাকলে কোনো ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
এছাড়া নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। আমরা নিজেরাই যদি দখলদার ফুটপাতে কেনাকাটা করি, তাহলে সমস্যার অংশ হয়ে যাই। গণমাধ্যমকে এই ইস্যুতে সোচ্চার থাকতে হবে এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে প্রভাব তৈরি করতে হবে। ফুটপাত কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়- এটি একটি নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তার প্রতীক। এই অধিকার যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেই দায়িত্ব কেবল নগর কর্তৃপক্ষের নয়, বরং পুরো সমাজের। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি, নাগরিক- সবাইকে একসঙ্গে পথ খুঁজতে হবে, যেন পথচারী ফিরে পায় তার ন্যায্য ‘পথ’।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে

প্যানেল

×