ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

পিলখানা হত্যাকাণ্ড

আওয়ামী প্রশ্রয়ে ভারতীয় সম্পৃক্তি এবং সুনিতা পালের প্রশ্ন

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ২ জুলাই ২০২৫

আওয়ামী প্রশ্রয়ে ভারতীয় সম্পৃক্তি এবং সুনিতা পালের প্রশ্ন

(গতকাল প্রকাশিতের পর)

সভা স্থগিত করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তাদের ফোন ধারাবাহিকভাবে ব্যস্ত ছিল। এর মধ্যে সামরিক গোয়েন্দার মাধ্যমে পিলখানা সম্বন্ধে তথ্য আসা শুরু করে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়া আমি সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে, যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রি-স্টোর অর্ডার’।
সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে বিডিআরের ডিজিকে ফোনে পাওয়া যায় উল্লেখ করে মঈন ইউ আহমেদ বলেন, ‘তিনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাকে দেন। তিনি (মহাপরিচালক) বলেন, দরবার চলাকালীন দুজন সশস্ত্র সৈনিক দরবার হলে প্রবেশ করে। একজন আমার (ডিজি) পেছনে এসে দাঁড়ায় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। অপরজন দরবার হল অতিক্রম করে বাইরে চলে যায়। তার পরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দরবার হলে উপস্থিত সৈনিকরা গণ্ডগোল শুরু করে দেয় এবং তারা দাঁড়িয়ে যায় এবং দরবার হল থেকে বের হয়ে আসে।’
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, ‘মনে হলো সব পরিকল্পনার অংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হচ্ছে। অনেকে মনে করে, বিডিআর ডিজি সাহায্যের জন্য আমাকে কল করেছিলেন। এটা সত্য নয়। আমি বিডিআর ডিজিকে ফোন করি এবং আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি, তা উনাকে জানিয়ে দিই।’
ওই দিন সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। জেনারেল মইন বলেন, ‘এর মধ্যেই তিনি (শেখ হাসিনা) বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় আমি তাকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে ব্রিগেডকে তৈরি করতে? আমি বললাম, সাধারণত ৬ ঘণ্টা লাগে। তবে তাড়াতাড়ি করে ২ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করা যায়।’
৪৬ ব্রিগেডকে পিলখানায় যাওয়ার অনুমতি শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন বলে জানান মঈন ইউ আহমেদ। ব্রিগেডটি ১ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে। ৪৬ ব্রিগেডের তৎকালীন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাকিমের নেতৃত্বে ১০ জন কর্মকর্তা ও ৬৫৫ জন সৈনিক পিলখানার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সকাল সাড়ে ১০টায় ব্রিগেডের অগ্রবর্তী দল জাহাঙ্গীর গেট অতিক্রম করে।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে বিভিন্ন অস্ত্র মোতায়েন করে। বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি পিলখানার মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। চালকের পাশে বসা একজন গুরুতর আহত হন।
জেনারেল মঈন জানান, ১০টা ৩৫ মিনিটের দিকে তিনি বিডিআর মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হয়তো এর আগেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
তিনি তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের বরাত দিয়ে বলেন, সম্ভবত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র‌্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তা পাননি। তিনি অনুমতি পেলে হয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুবিধা হতো এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কম হতো। 
মইন জানান, ঘটনার দিন, ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি (প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ) তাকে জানান, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে যে, কোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাই সরকার আদেশ দিয়েছিল, সেনাবাহিনীর সদস্যদের দৃষ্টির আড়ালে, অন্তত দুই কিলোমিটার উত্তরে চলে যেতে বলা হয়েছিল।
আনুমানিক দুপুর ১২টায় পিএসও ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে মঈন ইউ আহমেদকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যমুনায় যেতে বলেন। তিনি সেখানে যান। মঈন ইউ আহমেদ বলেন, দুপুর ১টার দিকে সাদা পতাকা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান। এরই মধ্যে সরকার থেকে বলা হলো, সেনাবাহিনী পিলখানার প্রধান ফটক এলাকায় থাকবে। র‌্যাব ও পুলিশ আরও দুটি এলাকায়। ডেইরি গেট এলাকাটি অরক্ষিত ছিল। ওই সময় পিলখানা থেকে পালিয়ে আসা একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, সেখানে অনেক সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।
মন্ত্রিসভার পর শেখ হাসিনা তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে আরেকটি ছোট বৈঠক করেন।
শেখ হাসিনা তাদের জানান, রাজনৈতিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা চলছে। শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম বিদ্রোহীদের একটি দলকে নিয়ে যমুনায় আসছেন এবং তারা (বিদ্রোহীরা) সাধারণ ক্ষমা চায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে তিন বাহিনীর প্রধান যেন তাদের বলেন।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, তখন আমি তাঁকে (শেখ হাসিনা) বলি, ‘অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোনো দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন, প্রথমত, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
একটা পর্যায়ে শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম ছিলেন। প্রথম পর্যায়ের আলোচনা তার (মঈন) জানা নেই। পরের পর্যায়ে তাকে ডাকা হয়। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য বলেন। বিদ্রোহীরা ৬টা ৩৭ মিনিটে যমুনা থেকে পিলখানার উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে তারা ঘোষণা দেয়, সাধারণ ক্ষমার প্রজ্ঞাপন না হলে তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তারা গোলাগুলিও শুরু করে। কর্মকর্তাদের খুঁজতে থাকে।
রাত ১২টায় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস ও তৎকালীন আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) পিলখানায় যান আলোচনার জন্য। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আটটি পরিবারকে মুক্তি দেয়। শুধু তিনটি পরিবার ছিল সেনা অফিসারদের। সাহারা খাতুন জানতেন অফিসারদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। তিনি তাদের মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেননি, কোনো খোঁজও নেননি, বলেন মঈন ইউ আহমেদ।
২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আবার গোলাগুলি শুরু করে বিদ্রোহীরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সকাল সাড়ে ১০টায় তাকে ডেকে নেন জানিয়ে মঈন ইউ আহমেদ বলেন, তাকে জানানো হয় বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ না করলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে।
জেনারেল মঈন বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় আমি যখন তদন্তের আদেশ দিই, তখন আমাকে বলা হয়; যখন সরকার এ বিষয়ে তদন্ত করছে, তখন আমাদের এর প্রয়োজনটা কী?’ প্রতি-উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এত সেনা অফিসার হত্যার কারণ আমাকে বের করতে হবে। তারপর সরকার আর উচ্চবাচ্য করেনি। তবে তদন্তে সরকার তেমন সহায়তা করেনি। সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা)।
ভারত দেখেছে তারা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যখনই কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর জন্য তারা অনেক কিছুই করতে পারেনি। বিডিআরে সেনাবাহিনীর অফিসাররা কমান্ডে থাকায় সেখানে ভারতীয় বিএসএফের ভূমিকা ম্লান ছিল। তাই ভারতীয় নীলনকশা অনুযায়ী বিডিআর এর কিছু দুষ্ট সদস্যদের হাত করা হয়। তারা যাতে সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেজন্য তথাকথিত ডাল-ভাত কর্মসূচি ও দুর্নীতির বিষয় সামনে আনা হয়। তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় এনে তাকে এমনভাবে শক্তিশালী ও চিরস্থায়ী করবে যাতে, সেটা পাকাপোক্ত হয়। সবকিছুই শেখ হাসিনার সঙ্গে বোঝাপড়া করেই পরিকল্পনা করা হয়। যাতে সবকিছু তার হাতের মুঠোয় থাকে এবং তিনি ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘায়িত করতে পারেন।
সশস্ত্র বাহিনীসহ দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও সব ধরনের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। একটি দেশে বহুদল, বহুমত থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, কিন্তু রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ছাড়া কখনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা যায় না। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শের জায়গায় একমত। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদ মোকাবিলায় বহুধাবিভক্ত। জাতীয় স্বার্থে আমরা যদি একত্রিত হতে না পারি তবে বিপর্যয় অনিবার্য। যা ফেরানো খুব কঠিন হবে। পিলখানা হত্যাকান্ডের জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন পিলখানায় আটকে পড়া সেনা কর্মকর্তাদের বারবার আকুতি সত্ত্বেও সময় মতো কোনো উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয়নি। সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা বিদ্রোহীদের হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ সংগঠনকে নির্বিঘ্ন করেছে। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অবহেলা, কিছু গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা এবং আলামত নষ্টের অপচেষ্টার কথাও উল্লেখ করেছে কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তের লক্ষ্যে একটি নতুন ৭ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এ কমিটি  ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। 
(সমাপ্ত)
লেখক : সাংবাদিক

প্যানেল

×