
ছবিঃ সংগৃহীত
আমরা সবাই জানি বরিশালকে বলা হয় বাংলার ভেনিস। শহরটির শুরু থেকে সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল নদী। অথচ আজ সেই নদীভিত্তিক যোগাযোগ পদ্ধতিই যেন ক্রমাগত অনির্ভরযোগ্য, অনিরাপদ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বরিশালের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চ রুটে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়ে একাধিক নিম্নচাপ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে। এতে সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। একদিকে নির্ভরযোগ্য বিকল্প ব্যবস্থা নেই, অন্যদিকে আগাম সতর্কবার্তার অভাব এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা গোটা সমস্যাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
একসময় বরিশাল অঞ্চলেই ছিল দক্ষিণ বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। সুগন্ধা, কীর্তনখোলা, তেঁতুলিয়া নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কৃষি, মাছের ব্যবসা, এবং যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা। এখনো প্রতিদিন শত শত লঞ্চ বরিশাল থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য ও যাত্রী বহন করে। এমনকি পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও ভোলা জেলার মানুষও বরিশালের লঞ্চ টার্মিনালের উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু নদীপথে যাতায়াত মানেই এখন যেন অনিশ্চয়তার সমার্থক। একটু বৃষ্টি বা নিম্নচাপেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে পরিষেবা। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যায়।
২০২৫ সালের জুনে উপসাগরীয় নিম্নচাপের কারণে বরিশাল-পটুয়াখালীসহ বেশ কয়েকটি মূল রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ধরণের পরিস্থিতিতে হাজারো যাত্রীদের আটকে পড়তে হয়। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার বা স্পিডবোটে যাত্রা করেন এ সময়ে।
এই ঘটনা শুধু একটি আবহাওয়া সতর্কতার প্রতিফলন নয়; বরং এটি এটাও দেখিয়ে দেয় যে বরিশালের নৌ পরিবহণ ব্যবস্থায় কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
মূল সমস্যা:
১. পরিকল্পনার অভাব
বর্ষা মৌসুমে কখন লঞ্চ বন্ধ হবে, কখন চালু হবে তা নিয়ে নেই কোনো আগাম নীতিমালা বা বিকল্প যাত্রাপথ। জনগণ ও লঞ্চ মালিক—দু’পক্ষই নির্ভর করে আবহাওয়া অফিসের ঘোষণার উপর।
২. প্রযুক্তির ঘাটতি
স্মার্ট নেভিগেশন-এর যুগেও অধিকাংশ লঞ্চে নেই GPS, রাডার বা স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া সতর্কতা ব্যবস্থা। দূরদর্শী রাষ্ট্র হলে এই নৌযানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক হতো।
তুলনার হিসেবে এখানে উল্লেখ করা যায়, ভারতের কেরালায় নদী ও ব্যাকওয়াটার অঞ্চল জুড়ে যে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা প্রযুক্তিনির্ভর ও যাত্রীবান্ধব। প্রতিটি সরকারি ফেরিতে জিপিএস, লাইফ জ্যাকেট, স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা এবং ট্রেনড অপারেটর থাকে। একইভাবে ভিয়েতনামের মেকং ডেল্টা অঞ্চলে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ নৌ যোগাযোগের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বে আধুনিকীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়েছে। বরিশালের মতো নদীকেন্দ্রিক অঞ্চলে এই ধরনের উদাহরণ অনুসরণযোগ্য হতে পারে।
৩. আবহাওয়া তথ্যের অভাব
যাত্রীরা, এমনকি লঞ্চ কর্তৃপক্ষকেও পর্যন্ত ভোগান্তিতে পড়তে হয় গুজব বা খণ্ডিত তথ্য পেয়ে। একটি অফিশিয়াল মোবাইল অ্যাপ থাকা উচিত যেখানে লাইভ আপডেট, লাল সতর্কতা ও সিগন্যাল দেখতে পাবেন সবাই—যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক জলোচ্ছ্বাস এখন আগের থেকে বেশি হবে বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে। বাংলাদেশের মধ্যে বরিশাল অঞ্চলের উপর প্রভাব পড়বে অনেক বেশি। অথচ এখনো এখানে নদীপথকে আবহাওয়া মোকাবেলা করার মতো বাস্তবিক উদ্যোগ অনুপস্থিত।
৫. শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
নৌচলাচল বন্ধের কারনে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয় শ্রমজীবী মানুষ। কারন তাদের দৈনিক আয় নির্ভর করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার উপর। দোকানপাটে পণ্য না পৌঁছানোয় দাম বেড়ে যায়, চাল-ডাল-মাছ সবকিছুর বাজার অস্থির হয়ে পড়ে।
শুধু তাই নয়, বহু শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় পরীক্ষায় বসতে পারেন না বা ইন্টারভিউ দিতে পারেন না। পর্যটন শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুয়াকাটা, চর কুয়াকাটা, দুমকি অঞ্চলের হাজারো হোটেল-রিসোর্টে বুকিং বাতিল হয় লঞ্চ বন্ধের খবর শুনে।
৬. নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও পরিবেশগত বিপর্যয়
নদীর স্বাভাবিক গতি ও গভীরতা রক্ষায় অবহেলা, অপরিকল্পিত ড্রেজিং এবং নদী দখল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলে। অনেক নদীতে বর্ষার সময় প্রবাহ বেড়ে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে তা সংকীর্ণ ও দুর্গম হয়ে পড়ে। ফলে বৈরী আবহাওয়ায় যখন জরুরি চলাচল দরকার হয়, তখন নদীপথ আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। জলযান চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সুষ্ঠ ড্রেজিং, নদী দখলমুক্তকরণ এবং নদীর গতিপথ সংরক্ষণ জরুরি।
যা করণীয়:
১. যুগোপযোগী আবহাওয়া সতর্কতা ব্যবস্থা আরও কার্যকর করা
বাংলা ভাষায় অডিও সহ একটি মোবাইল অ্যাপে পূর্বাভাস প্রদানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি যেখানে নৌযাত্রী, চালক এবং নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ সাথে সাথে লঞ্চ চলাচলের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পারবেন। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস এখনো অনেকাংশে অনির্ভরযোগ্য বা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তাই একটি ডিজিটাল এলার্ট সিস্টেম চালু করা যেতে পারে, যা প্রতিটি নৌযান চালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপকদের সতর্ক বার্তা পাঠাবে।
এছাড়া ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপ চলাকালে কোন রুট চালু থাকবে, কোন বন্দর বন্ধ থাকবে, এবং কোন বিকল্প বন্দর বা ব্যবস্থা ব্যবহারযোগ্য এই তথ্যসমূহও এই অ্যাপেই সহজে জানা যাবে। এতে যাত্রীদের বিভ্রান্তি অনেক কমবে এবং পূর্ব প্রস্তুতির সুযোগ তৈরি হবে।
২. নৌযানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা
প্রতিটি মাঝারি ও বড় লঞ্চে জিপিএস, AIS (Automatic Identification System), রাডার এবং পর্যাপ্ত লাইফজ্যাকেট ও ফায়ার সেফটি গিয়ার বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাশাপাশি, দুর্ঘটনার সময় কীভাবে যাত্রীদের নিরাপদে সরানো যায় সে বিষয়ে মাস্টার ও ক্রুদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ জরুরি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ এই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারে।
প্রতিটি লঞ্চে ব্ল্যাকবক্স থাকলে দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণে সহায়তা হবে। একই সঙ্গে যাত্রীদের জন্য লাইভ ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করলে তারা মোবাইল অ্যাপে দেখে নিতে পারবেন তাদের লঞ্চ বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছে।
৩. ঋতুভিত্তিক যাতায়াত পরিকল্পনা ও বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি
বর্ষাকাল ও শুষ্ক মৌসুমে আলাদা অপারেশনাল গাইডলাইন থাকা উচিত। কোন সময়ে কোন রুট চালু থাকবে, কোন রুট বন্ধ থাকবে তা আগেই ঘোষিত হওয়া দরকার। এজন্য একটি জলপথ পরিচালনা ম্যানুয়াল প্রণয়ন করা যেতে পারে।
বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে সড়ক-নৌ সমন্বিত বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা (যেমন বাস ও ফেরি সংমিশ্রণ, ট্রলার সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রভৃতি) চালু করে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
৪. নদীপথ উন্নয়ন বোর্ড গঠন
জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বরিশালে একটি “নদীপথ উন্নয়ন ও নিরাপত্তা কমিটি” গঠন করা উচিত। এই বোর্ডে জনপ্রতিনিধি, নৌযান মালিক, ট্রাফিক প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রকৌশলী ও সচেতন নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কমিটি নদীভাঙন, দখল, নাব্যতা সংকট ও নিরাপত্তা ইস্যুতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ পেশ করবে। একই সঙ্গে এটি নদীপথে উন্নয়ন প্রকল্পের মান যাচাই এবং নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৫. জরুরি হেল্পডেস্ক, অভিযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যভাণ্ডার তৈরি
প্রতিটি মূল বন্দরে ২৪ ঘণ্টা খোলা একটি হেল্পডেস্ক থাকতে হবে, যেখানে যাত্রী তথ্য, রুট আপডেট ও জরুরি সহায়তা পাবেন। এছাড়াও অনলাইন অভিযোগ, রেটিং ও পর্যালোচনার প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার, যাতে যাত্রীরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন যাতে দুর্বল সেবাদানকারী সংস্থাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়। যাত্রা সংশ্লিষ্ট সব তথ্য যেমন যাত্রার সময়, বাতিল হওয়া ট্রিপ, টিকিট অবস্থা, দুর্ঘটনার তথ্য একটি কেন্দ্রীয় নৌপরিবহন ডেটাবেসে সংরক্ষণ করে রাখলে ভবিষ্যতে নীতিগত পরিকল্পনা আরও তথ্যনির্ভর ও কার্যকর হবে।
বরিশালের মূল পরিচয় যে নদী, সেই নদীর কারনেই বরিশাল এখন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। উন্নয়ন যদি বাস্তবভিত্তিক না হয়, প্রযুক্তিনির্ভর না হয়, তবে তা জনগণের খুব কম কাজেই এসে থাকে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি ৯) অন্যতম উদ্দেশ্য হলো নিরাপদ, টেকসই ও স্থিতিশীল অবকাঠামো নিশ্চিত করা। বরিশালের নদীপথে বিনিয়োগ, পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি সংযুক্তির মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র একটি শহর নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সচল রাখতে পারি। সরকারের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নাগরিক সচেতনতা একত্রে কাজ করলে বরিশাল হতে পারে বাংলাদেশের নদীনির্ভর নগর উন্নয়নের একটি সফল মডেল।
তাই এখনই সময় বরিশালের নদীপথকে আরও আধুনিক ও টেকসই করার, নতুবা বরিশাল শুধু তার অতীত হারাবে না, হারাবে তার ভবিষ্যৎও।
লেখক: শেখ আফনান বিরাহীম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়
ইমরান