ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধের বাস্তবতা

মো. আরিফ উল্লাহ

প্রকাশিত: ২০:১৪, ১ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধের বাস্তবতা

কিছু রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ যেন এখন খেলায় পরিণত হয়েছে। তারা সুযোগ পেলেই আগ বাড়িয়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা দেখাতে উঠে পড়ে লাগে। আর এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য ২টি জিনিস প্রয়োজন। প্রথমত সন্ত্রাসী ট্যাগ দেওয়া। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধ করার অজুহাত দেওয়া। এই দুই ধরণের ট্যাগ কোনো দেশে লাগিয়ে দিতে পারলেই যেন সেসব দেশকে যুদ্ধের নামে ধ্বংস করার বৈধতা পাওয়া যায়। 
আমরা প্রতি বছর এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের আর্মড কনফ্লিক্ট এর সাক্ষী হই। সেটা ভারত-পাকিস্তান, চীন-ভারত, চীন-তাইওয়ান, রাশিয়া-জর্জিয়া, চীন-জাপান কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থানে হয়ে থাকে। ২০০০ সালের পর থেকে আমরা এমন কিছু যুদ্ধ দেখেছি যা শুধু নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে। যেমন-  ২০০১ সালে আফগানিস্তান যুদ্ধ, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজা-ইসরায়েল দেখছি। এই যুদ্ধগুলো  বিশ্ববাসীকে কিছু বার্তা দিয়ে গেছে, যে তুমি যদি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের নাগরিক না হও তাহলে তোমার মানবাধিকার শুধু বিভিন্ন নামে বেনামের চুক্তি এবং কনভেনশন এর পাতায় আবদ্ধ থাকবে।  
কথা হচ্ছে কোনো দেশ চাইলেই কি যুদ্ধে জড়াতে পারে? নিঃসন্দেহে এর উত্তর হলো না। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু ক্ষেত্র বিশেষে একটি দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করার বৈধতা পায়, তার মধ্যে জাতিসংঘ সনদ (UN charter) এর ৫১ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে যদি কোনো দেশ সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে সেই দেশ নিজের আত্মরক্ষার নিমিত্তে যুদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন (UNSC Authorization) কর্তৃক যদি কোনো দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকি বিবেচনায় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে সেই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে। অন্য ক্ষেত্রে কোনো প্রকার যুদ্ধ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এখন যে চিত্র দেখা যায়, তা হচ্ছে এক দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠী যদি অন্য দেশে আক্রমণ করে তাহলে সেই দেশ জাতিসংঘ সনদের ৫১ নং অনুচ্ছেদকে পুঁজি করে ঐ দেশে হামলা করে।  
যা মোটেও কাম্য নয় এবং এই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এখানে ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আক্রান্ত দেশ সেই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজের আত্মরক্ষার অধিকারী হয়। আমরা যদি গাজা কিংবা কিছুদিন আগের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে তাকাই তাহলে এখানে অস্পষ্ট একটি গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে নিরীহ মানুষ হত্যা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। উল্লেখ্য যে, এমন ঘটনা মোটেও নতুন নয়। অপরদিকে জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, যদি কোনো দেশ অন্য আরেকটি দেশের ওপর নিছক অজুহাতে আক্রমণ করে তাহলে তা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ যুদ্ধ বা 'war of aggression' বলে বিবেচিত হবে। এর যথাযথ একটি উদাহরণ হতে পারে ২০০৩ সাল যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকের ওপর আক্রমণ, যা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল।
চিন্তার বিষয় হলো, ধরনের যুদ্ধ একের পর এক লেগেই আছে কেন? বা এর সমাধান কি হতে পারে? সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অনেক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি লোভ, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করতে, জাতি, ধর্মীয় ও আদর্শগত বিভাজন, অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধ অর্থনীতি এবং দুর্বল রাষ্ট্রব্যবস্থা বা কূটনীতি, যার ফলে বিশ্বে কোনো না কোনো প্রান্তে একের পর এক যুদ্ধ বা আর্মড কনফ্লিক্ট লেগেই থাকে। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে আইসিজে কর্তৃক প্রদত্ত করা রায় বাস্তবায়ন না হওয়া, যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার অভাব।  
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোকে তাদের বিতর্কিত নীতি থেকে ফিরে আসতে হবে। যেমন- আমেরিকা এই নীতি অনুসরণ করে যে, কোনো দেশ যদি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আক্রান্ত দেশ সেই ভূখন্ডে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারবে। যুদ্ধের চেয়ে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেয়া, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ)  এর এর রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকে তাগাদা দিতে হবে এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জাতিসংঘকে আগভাগে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই হয়তো বিশ্বে শান্তির হাওয়া বইতে পারে। যুদ্ধ কখনোই দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথ নয়, সামরিক ক্ষমতা নয় বরং আন্তর্জাতিক সংগতি, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধই হতে পারে সত্যিকারের বিশ্বশান্তির ভিত্তি। 

লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

প্যানেল

×