
কথায় আছে যে, ‘জনগণের টাকায় সরকার চলে’। আসলে তাই। জনগণ যদি সরকারকে ট্যাক্স না দেয়, তবে রাষ্ট্রের খরচ আর উন্নয়ন হবে না। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বের নিয়ম। রাজস্ব খাত রাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাত। আর সেই রাজস্ব খাতেই চলেছে দীর্ঘ আন্দোলন। এতে করে সরকারের আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিপন্নতা এসেছে। রাজস্ব আদায় চরমভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়েছিল সরকার।
গত প্রায় দুই মাসের আন্দোলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে ধারাবাহিক কর্মসূচির ডাকে নানা ধরনের কর্মসূচি চলে। তবে ব্যবস্যা বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব কর্মসূচির ফলে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য চালানের শুল্কায়ন কার্যক্রম, ব্যাহত হয় প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। যাহোক, শেষ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত হয়েছে।
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রতিদিনের অচলাবস্থায় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়। ফলে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনা করে এর সমাধান চেয়েছিলেন তারা। এনবিআরের অচলাবস্থায় দৈনিক আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়েছে। তুলনামূলক ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ার শঙ্কায়। দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পোর্টে, বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকায় বৃষ্টি-রোদে নষ্ট হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা আরও বলেছেন, কানো সমস্যা টেবিলে বসে সমাধান করা যায় না- সেটা আমরা বিশ্বাস করি না। বসতে হবে, কথা শুনতে হবে, কিছু ছাড় দিতে হবে। কিন্তু এনবিআরের সংস্কার হতে হবে।
আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করতে হবে। বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে রাজস্ব নীতি পৃথকীকরণের কাঠামো কি রূপে প্রণীত হবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং রাজস্ব নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম পৃথকীকরণের লক্ষ্যে জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সব সংশোধনী আনতে হবে। সেই সঙ্গে তারা এনবিআর চেয়ারম্যানে অপসারণ দাবিও তুলে।
ব্যবসা-বিনিয়োগে আস্থাহীনতা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ। ব্যবসা প্রসার ও নতুন বিনিয়োগ নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষা। সেই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাহিদা কমায় এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সে হিসাবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনের প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হতো। তবে প্রথম ৯ মাসে আদায়ের ক্ষেত্রে বিরাট রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা আদায়ের কাছাকাছি যাওয়াকেও খুবই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দিনপ্রতি আরও ১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজস্ব মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, বড় ব্যবসায়ীরা অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্য রেখে পালিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটা তো স্বাভাবিক।’ সংস্থাটির তথ্য বলছে, ৯ মাসে মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। যদিও এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় ৯ মাসে মোট ৩ লাখ ২২ হাজার ১৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ এখন বাকি তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় করতে হবে দুই হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা অর্থবছরের দৈনিক গড় আদায়ের চেয়ে এক হাজার কোটি টাকা বেশি। লক্ষ্য পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কর ফাঁকি রোধ, নন-কমপ্লায়েন্ট করদাতাদের নোটিস দিয়ে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের তুলনায় মোটামুটি প্রবৃদ্ধি আছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যাওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং।’
আলোচ্য এ সময়ে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর- এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে। আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। এ খাতে ঘাটতি ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকার মতো। আয়কর খাতে ঘাটতির পেছনে মূল কারণ এই সময়ে আয়ের সুযোগই তৈরি হয়নি। ব্যবসাবাণিজ্য সীমিত থাকায় এই খাতে তার প্রভাব পড়েছে। এছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় অগ্রিম আয়কর আদায়ও কমেছে। রাজস্ব আদায়ে বড় অবদান রাখে ভ্যাট খাত। আমদানি, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন, সরবরাহ, জোগানদার পর্যায় পর্যন্ত এই খাতের বিস্তৃতি। এর সর্বশেষ ধাপ ক্রেতা বা ভোক্তা। আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে এই খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে।
এছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক আদায় করে এনবিআর। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ কমায় আবগারি শুল্কেও পড়েছে এর প্রভাব। কমেছে উৎপাদনও। শিল্প কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক আদায়ে ঘাটতি দেখা গেছে। ব্যবসাবাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানি সহজে বাড়বে না। কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায়ও এ খাতে আদায় কমেছে। যদিও এতে দেশের মানুষ উপকৃত হয়েছে।
গত বছর জুলাই মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়। তখন প্রায় সব কিছু বন্ধ ছিল বললেই চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়ে শুল্ক-কর আদায়ে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, যার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে।
‘রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ত্রুটি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেশকিছু খাতে নতুন করে করছাড়, আমদানি কমে যাওয়াই রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ। তবে এই সমস্যা মূলত কাঠামোগত। কর ফাঁকি রোধে বেশি উন্নতি হয়নি। পরামর্শক কমিটির সুপারিশকে ভিন্নভাবে এনে ক্যাডারভিত্তিক করায় একটা দোটানা তৈরি হয়েছে। সংস্কারপ্রক্রিয়াও ধাক্কা খেয়েছে। এখন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে করছাড় কমিয়ে আনা, দুর্নীতি রোধ করা, সম্পত্তিসহ যেসব জায়গা থেকে কর আদায় হয় না সেখান থেকে আদায় করা এবং বিভিন্ন ডেটাবেইস একসঙ্গে করতে হবে।’
রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়ে, যা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যায়। রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করতে হলে, সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন উৎস খুঁজে বের করতে হবে, সেই সঙ্গে কর ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল