
ছবি: সংগৃহীত
অফিসে কেউ কেউ থাকে যারা মনে হয় আত্মবিশ্বাসে ঠাসা। তারা নিজের সাফল্য নিয়ে অহরহ কথা বলে, অন্যের ভুল ধরায় আনন্দ পায়, এবং নিজের চলাফেরা দিয়েই যেন বলে—“আমি সব জানি।” কিন্তু অনেক সময় সেই জোরালো আত্মবিশ্বাসের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে গভীর এক ইনসিকিউরিটি ।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ইনসিকিউরিটি হলো এমন এক মানসিক অবস্থা যা আত্ম-অপর্যাপ্ততার অনুভূতি থেকে জন্ম নেয় এবং তা অনেক সময় মানুষ নিজেই বুঝতে পারে না। নিচে এমন ৮টি লক্ষণ তুলে ধরা হলো যা দেখলে বুঝতে পারবেন—আপনি বা আপনার আশেপাশের কেউ হয়তো নিজের অজান্তেই গভীর অসুরক্ষাবোধে ভুগছেন।
১. প্রায় প্রতিটি কথায় নিজেকে বড় করে তুলে ধরা
কোনো মানুষ যদি বারবার নিজের কৃতিত্ব, ডিগ্রি, অর্জন কিংবা অভিজাত পরিচয় তুলে ধরেন—তাও এমনভাবে যেন তা প্রসঙ্গের সঙ্গে যায় না—তাহলে সেটিকে সাধারণ আত্মবিশ্বাস বলে ভুল করা যায়। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই এই আচরণ ভেতরের গভীর অনিরাপত্তা বা defensive self-esteem-এর ফল।
উদাহরণ:
“এক কাপ কফি নেব—যেমনটা হার্ভার্ডে আমার ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের আগে খেয়েছিলাম।”
এই ধরনের কথায় প্রধান লক্ষ্য থাকে নিজের কৃতিত্ব জাহির করা।
২. সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সমালোচনাও সহ্য করতে না পারা
যেকোনো মানুষের পেশাগত বা ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য গঠনমূলক সমালোচনা অপরিহার্য। আত্মবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে স্থিতিশীল ব্যক্তিরা সমালোচনাকে দেখেন শেখার সুযোগ হিসেবে। তারা মতামত গ্রহণ করে নিজেদের কাজে উন্নতি আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু গভীরভাবে অনিরাপত্তায় ভোগা মানুষদের জন্য সমালোচনা একধরনের আত্মপরিচয়ের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের প্রতিক্রিয়া হয় তিনভাবে:
-
রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করা
-
দোষ চাপানো ("আপনি বুঝতে পারেননি")
-
অথবা একদম চুপ হয়ে যাওয়া বা দূরে সরে যাওয়া
Carol Dweck-এর গবেষণা কী বলছে?
বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী Carol Dweck তাঁর “Fixed vs. Growth Mindset” তত্ত্বে দেখিয়েছেন:
-
Fixed Mindset-এর মানুষ বিশ্বাস করেন তাদের মেধা বা দক্ষতা জন্মগত এবং অপরিবর্তনযোগ্য। ফলে, কেউ যখন তাদের কাজ নিয়ে কিছু বলে, তারা সেটিকে দেখে ব্যক্তিত্বে আঘাত হিসেবে।
-
অন্যদিকে, Growth Mindset-এর মানুষ মনে করেন চেষ্টা, পরিশ্রম ও শেখার মাধ্যমে যেকোনো দক্ষতা অর্জন সম্ভব। তাই তারা সমালোচনাকে দেখেন উন্নয়নের সিঁড়ি হিসেবে।
উদাহরণস্বরূপ, অফিসের এক মিটিংয়ে কেউ যদি বলেন, “এই রিপোর্টে তথ্যটা আরও স্পষ্ট হলে ভালো হতো”—
একজন আত্মবিশ্বাসী কর্মী হয়তো বলবেন, “ঠিক বলেছেন, আমি সেটা ঠিক করে নিই।”
কিন্তু ইনসিকিউরিটিতে ভোগা কেউ হয়তো বলবেন, “মানে? আপনি বলতে চাইছেন আমি কিছু পারি না?”
৩. সারাক্ষণ অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা
কেউ একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছুটি কাটানোর ছবি পোস্ট করল, সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনের মনে হলো, “আমার জীবন এত একঘেয়ে কেন?”
অন্যজনের পদোন্নতি দেখেই মনে হতে পারে, “আমি তো পিছিয়ে পড়ছি।”
বয়স, বেতন, পোশাক, মোবাইল, এমনকি স্টেপ কাউন্ট—সব কিছুতেই তুলনা চলে।
এমন অবিরাম তুলনা করা কেবল মন খারাপের কারণই নয়, বরং এটি গভীর ইনসিকিউরিটির ইঙ্গিত।
৪. বড় কোনো সুযোগের আগে নিজেই নিজের ক্ষতি করে ফেলা
প্রেজেন্টেশন ঠিক আছে, প্রস্তুতিও ঠিকঠাক—তবু আগের রাতেই চলে গেলেন পার্টিতে।
অথবা, স্বপ্নের চাকরির সাক্ষাৎকারের দিন “অজান্তে” দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেন।
এগুলো শুধু সময় ব্যবস্থাপনার সমস্যা নয়—এগুলো হলো self-handicapping বা স্বেচ্ছায় নিজের জন্য বাধা তৈরি করার মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা।
Self-handicapping কী?
মনোবিজ্ঞানীরা একে ব্যাখ্যা করেন, নিজের যোগ্যতা যাচাইয়ের ভয় থেকে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করে যা তার পারফরম্যান্সে বাধা সৃষ্টি করে।
তাতে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সে বলতে পারে—
“আমি তো পুরোপুরি চেষ্টা করিনি”, “ঘুম হয়নি”, “প্রস্তুতি কম ছিল”—
অর্থাৎ, ব্যর্থতার জন্য নিজের দক্ষতাকে দায়ী না করে বাহ্যিক কারণ দেখানো যায়।
৫. অতি‑দুঃখপ্রকাশ ও অতিরিক্ত ব্যাখ্যা
"মাফ করবেন, ইমেইলে একটি টাইপো হয়েছে!"
"দুঃখিত, কফিটা একটু ঠান্ডা!"
"দুঃখিত, আপনাকে বিরক্ত করলাম!"
— এমন কথাগুলো প্রায়ই আমরা অনেকের মুখে শুনি, এবং অনেকে নিজেরাও ব্যবহার করি।
কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, এসব অতিরিক্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা আসলে এক ধরনের গভীর ইনসিকিউরিটির প্রকাশ।
এই আচরণের পিছনের মানসিকতা কী?
যারা প্রতিনিয়ত দুঃখপ্রকাশ করেন বা অতি ব্যাখ্যা দেন, তাদের মনের ভেতরে একটি স্থায়ী ভয় কাজ করে:
- “যদি আমি পুরোপুরি বিনীত না হই, তাহলে মানুষ আমাকে অপছন্দ করবে।”
- “আমি যদি একটু ভুল করি, সবাই হয়তো আমাকে অযোগ্য ভাববে।”
এই ধরণের ভয় থেকেই তারা নিজের সাধারণ আচরণ বা মানবিক ভুলের জন্যও ক্ষমা চাইতে বাধ্যবোধ করেন।
৬. সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা ও পরীক্ষা
“তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো তো?”, “তুমি কেন আমাকে ট্যাগ করলে না?”
এমন প্রশ্নের পেছনে রয়েছে attachment anxiety, যেখানে নিজের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে গভীর সংশয় থাকে মানুষটি।
৭. প্রশংসা এলে নিজেকে খাটো করা
"তোমার প্রেজেন্টেশনটা দারুণ ছিল!"
"আরে না ভাই, আমি তো গুঁড়িয়ে ফেলেছি সব। ভাগ্যক্রমে কেউ টের পায়নি!"
এমন কথোপকথন প্রায়ই শোনা যায়, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্র বা পড়াশোনার জায়গায়। অনেকেই সত্যিকারের প্রশংসার পরও নিজেদের অবদান স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করেন। অথচ এই প্রশংসা খারিজ করে দেওয়ার অভ্যাসটি ইনসিকিউরিটির একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর লক্ষণ।
৮. কখনো সব নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, কখনো সব ছেড়ে দেওয়া
কোনো কাজে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, আবার কোথাও একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকা—দুটিই ইনসিকিউরিটির প্রকাশ। সুস্থ আত্মবিশ্বাস জানে কখন নেতৃত্ব দিতে হয়, আবার কখন অন্যকে দায়িত্ব দিতে হয়।
মুমু ২