
গ্রামের মেঠোপথ হোক, কিংবা মফস্বলের ব্যস্ত বাজার আজকাল এক চেনা দৃশ্য চোখে পড়ে হরহামেশাই। চুলে স্টাইল দেওয়া, গায়ে টি-শার্ট এক কিশোর ইজিবাইকের স্টিয়ারিংয়ে। পাশে যাত্রী বসে আছে, গাড়ি ছুটে চলেছে। দেখে কে বলবে এই চালকের বয়স হয়তো মাত্র তেরো কিংবা চৌদ্দ! বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এখন ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক সহজলভ্য এক বাহন। কিন্তু এই সহজলভ্যতা এক নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শিশু-কিশোরদের হাতে রাস্তাঘাটের দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে।
প্রথমত, এই ইজিবাইক চালানোর জন্য কোনো রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স দরকার পড়ে না। ফলে কিশোররাও অনায়াসে এগুলো চালিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনো ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে পড়ে পরিবার কিনে দিচ্ছে একটি গাড়ি, আবার কখনো কেউ ভাড়ায় নিয়ে চালাচ্ছে। ব্যাটারি চালিত এই বাহনগুলোকে নিরাপদ মনে করা হলেও, বাস্তবতা ভিন্ন। বিদ্যুতে চার্জ দেওয়া এই যানবাহনে অনেক সময় শর্ট সার্কিট, অতিরিক্ত চার্জিং বা নিম্নমানের ব্যাটারির কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের ঘটনাও সামনে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। চলাচলের পথে যতটুক এসব ঝুঁকি তারচেয়ে বেশি ঝুঁকি দিনশেষে যখন চালক চার্জিং পয়েন্টে নিয়ে যায় চার্জ দিতে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, এসব অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহার। রোডের মাঝখান দিয়ে উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, মোবাইলে কথা বলতে বলতে স্টিয়ারিং ধরেছে, নিয়ম-কানুন যেন কেবল শহরের বড়দের জন্যই।
গ্রামাঞ্চলের স্টেশনগুলোতে সিরিয়াল অনুযায়ী যাত্রী তোলার রেওয়াজ আছে। এজন্য কোনো কিশোর চালক সিরিয়ালে থাকলে যাত্রীদের না চাইতেও যেতে হয়। এতে বাড়ছে অনিরাপত্তা, বিশেষ করে নারী ও শিশু যাত্রীদের জন্য। শুধু এসব কিশোর চালকদের জন্য যাত্রীরা অনিরাপদ তা নয়। বরং সবচেয়ে ভয়ের বিষয়, একটি সংঘবদ্ধ চক্রের পাল্লায় পরে এসব অল্প বয়সী চালকদের সব হারাতে হয়। কখনো অতিরিক্ত ভাড়ার প্রলোভন দেখিয়ে একটি চক্র এরকম কম বয়সী চালকদের টার্গেট করে দূরে কোথাও নিয়ে যায়। এরপর নির্জন কোনো পথে নিয়ে গিয়ে ইজিবাইক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় কখনো চালককে আহত করে ফেলে রেখে দেয় রাস্তার ধারে আবার কখনো মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না চক্রটি।
এই সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে এক অর্থনৈতিক অসহায়ত্বও। পরিবারে উপার্জনের অভাব, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া কিশোর, কিংবা অভিভাবকের অজ্ঞতা সব মিলে শিশু-কিশোররা রাস্তায় নামছে চালক হয়ে। অথচ এ বয়সে থাকার কথা স্কুলে, খেলার মাঠে, স্বপ্ন গড়ার পথে। এই সমস্যার সমাধানে প্রথমেই প্রয়োজন সরকারি পর্যায়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালানোর ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়সসীমা, প্রশিক্ষণ ও রেজিস্ট্রেশনের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। এই বাহনের অপব্যবহার ঠেকাতে প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট বা পারিবারিক চাপে সন্তানকে অল্প বয়সে রাস্তায় নামানো যেমন অমানবিক, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও। স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এসব অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অবশেষে, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বাড়ানোই পারে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে এবং রাস্তাঘাটকে করে তুলতে নিরাপদ। এই সমস্যা শুধু আইন দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু যে শিক্ষা ও শৈশব হারাবে, তা-ই নয়, রাস্তাঘাটও হয়ে উঠবে আরেকটি ‘ঝুঁকির রাজপথ’।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল