ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

গ্রাম কি হারিয়ে যাবে!

মিশকাতুল ইসলাম মুমু

প্রকাশিত: ১৮:৩১, ৪ জুলাই ২০২৫

গ্রাম কি হারিয়ে যাবে!

একদা গ্রাম ছিল বাংলার প্রাণকেন্দ্র। দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ, শান্ত নদী, সবুজে ঘেরা বৃক্ষরাজি আর মাটির গন্ধমাখা সরল জীবন ছিল গ্রামের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আজ শহুরে চাকচিক্য আর আধুনিকতার হাতছানিতে সেই গ্রাম ক্রমশ তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। গ্রামের সবুজ প্রকৃতি ম্লান হচ্ছে ইটের জঙ্গলের ভিড়ে, আর সরল গ্রাম্য জীবন মিশে যাচ্ছে শহুরে যান্ত্রিকতার স্রোতে। এই পরিবর্তন কেবল ভৌগোলিক নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক বন্ধনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা একদিকে যেমন উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়, তেমনই অন্যদিকে বিলুপ্তির হুমকিতে ফেলছে আমাদের আবহমান গ্রামীণ সত্তাকে। মানুষের গ্রামীণ জীবন থেকে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এখন এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত কারণ। শহরের উন্নত শিক্ষা, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, বৈচিত্র্যময় কর্মসংস্থান, বিনোদনের সুযোগ এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো সুবিধাগুলো গ্রামের মানুষের কাছে এক আকর্ষণীয় স্বপ্নের মতো। এর বিপরীতে, গ্রামে শিক্ষার নিম্নমান, ভালো হাসপাতাল ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব, কর্মসংস্থানের সংকট এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব মানুষের মন থেকে গ্রামকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, যারা কৃষিকাজ বা চিরাচরিত পেশায় ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, তারা আধুনিক জীবনযাপন, ভালো বেতন এবং সামাজিক মর্যাদার আশায় শহরের দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির ভঙ্গুরতা যেমন: কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব ও কৃষিতে বৈচিত্র্যের সংকট- মানুষকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার খোঁজে শহরমুখী করছে। অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় গ্রাম-শহরের বৈষম্যও এই স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করছে। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দক্ষ শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে গ্রামীণ জনগণ বাধ্য হচ্ছে শহরের ওপর নির্ভরশীল হতে। ফলে জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পেতে গ্রামের মানুষ ক্রমেই শহরের দিকে ছুটছে।
বর্তমান সময়ে শহুরে জীবনের প্রতি মানুষের একতরফা আকর্ষণের ফলে আমাদের গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতি চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলার পালাগান, জারি-সারি, যাত্রা, লোকনৃত্য, গ্রামীণ মেলা ও উৎসব ছিল প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব পরিচয়। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে সেই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। তরুণ প্রজন্ম শহুরে জীবনযাত্রার অনুকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ঐতিহ্যবাহী পেশাগুলোর- যেমন কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে ইত্যাদির কদর কমে যাচ্ছে এবং নতুনরা এসব পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে গ্রাম তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে। পাশাপাশি শহরমুখী অভিবাসনের ফলে শহরে জনসংখ্যা বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে, যা সৃষ্টি করছে আবাসন সংকট, যানজট, পরিবেশ দূষণসহ নানান সামাজিক সমস্যা। অন্যদিকে গ্রামগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ছে, কৃষিজমি অনাবাদী থাকছে, এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রামে আগে যেখানে একতা ও সহমর্মিতার বন্ধন ছিল, এখন তা ক্ষীণ হয়ে গেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে পড়েছে, আর শহরের আত্মকেন্দ্রিক জীবনে মানুষের সম্পর্ক শীতল হয়ে উঠেছে। গ্রামের মানুষদের মধ্যে যে আন্তরিকতা ও সামাজিক বন্ধন ছিল, তা এখন বিলুপ্তির পথে। সভ্যতার হাতছানি, চাকচিক্যময় জীবনের প্রলোভন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার আকর্ষণ- সব মিলিয়ে আজকের যুবসমাজ, এমনকি মধ্যবয়সীরাও গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া শুধু জনসংখ্যা স্থানান্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর প্রভাব পড়ছে আমাদের সংস্কৃতি, সমাজ এবং অর্থনীতিতেও। তরুণরা এখন আর গ্রামে ফিরতে চায় না। তারা শহরের চাকরি, অনলাইন ব্যবসা বা পড়াশোনায় ব্যস্ত। ফলে কৃষিকাজে শ্রমশক্তির অভাব দেখা দিচ্ছে, উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। শহরে শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর যেন এক প্রকার বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। অথচ গ্রামেই যদি মানসম্মত সেবা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা যেত, তাহলে এই অসমতা কমানো যেত। অপরদিকে, অপরিকল্পিত নগরায়ণে শহরগুলো জনাকীর্ণ ও সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠছে- আবাসন সংকট, যানজট, দূষণ ও বস্তির দুর্দশা এখন নিত্যদিনের চিত্র। এই অবস্থা কেবল ব্যক্তি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ব্যর্থতাও নির্দেশ করে। তাই গ্রাম ও শহরের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। গ্রামকে বাঁচাতে হলে সুষম উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। গ্রামের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটাতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে গ্রামে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে গ্রামে উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং আধুনিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রামে ভালো হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্থাপন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো প্রয়োজন। গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। লোকশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা, গ্রামীণ মেলা ও উৎসবের আয়োজন এবং ঐতিহ্যবাহী পেশাগুলোর পুনরুজ্জীবনে জোর দিতে হবে। গ্রামীণ পর্যটনের প্রসারও গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে বোঝানো জরুরি। গ্রামকে কেবল জীবিকার উৎস হিসেবে না দেখে আমাদের শেকড় হিসেবে দেখতে হবে। শহরকেন্দ্রিক চাপ কমিয়ে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের পথ সুগম করতে পারলেই টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। গ্রাম বাংলাদেশের প্রাণ, আর এই প্রাণ যদি আমরা শহরের মোহে হারিয়ে ফেলি, তবে নিজেদের শিকড়কেই কেটে ফেলব। শুধু উন্নয়নের নামে সবকিছু শহরমুখী করে তুললে সামাজিক ভারসাম্য ভেঙে পড়বে, তৈরি হবে নানা সংকট। বর্তমানে গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। যদি আমরা এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তাহলে হয়তো একদিন গ্রাম শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকবে। অথচ গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনযাপন আমাদের জাতীয় পরিচয় ও অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই গ্রামকে রক্ষা করা এবং শহরের মোহের বাইরে এসে গ্রামের স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনা আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন এবং গ্রামীণ জীবনের পুনরুজ্জীবনই পারে এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে। গ্রামের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারলে তা শুধু গ্রাম নয়, সমগ্র দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×