
আওয়ামী লীগ দলটি ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে শাসনকালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র থেকে পশ্চাদপসরণ ঘটে এবং দলটি ধারাবাহিকভাবে কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরতান্ত্রিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। অন্যান্য সেক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা খাতেও ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। বিভিন্ন সময়ে (বিশেষভাবে ২০১৮ ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে) জনবল কাঠামোর সংশোধনী এনে তাদের ঘরনার শিক্ষকদের প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত করে। দলীয়করণের ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির কারণে যোগ্য শিক্ষকদের বড় অংশ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্যাসিবাদের আমলে প্রণীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ২০২১ এর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হলো-
ক) কাম্য শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে না পারার বঞ্চনা :
বিগত পতিত সরকারের স্থানীয় এমপিদের সভাপতিত্বে দলীয় গভর্নিং বডি গঠনের মাধ্যমে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে জাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ডিগ্রি কলেজ সময়ে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। বিভিন্ন অজুহাতে ভিন্নমতের সিনিয়র শিক্ষকদের বরখাস্ত করে/বঞ্চিত করে দলীয় বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত জুনিয়র শিক্ষকদের বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রদান করে। এছাড়াও সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য ভিন্নমতের মেধাবী শিক্ষকদের তুচ্ছ অভিযোগে পদোন্নতি বঞ্চিত করে (কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে) জুনিয়র দলীয় শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রদান করে এবং ভবিষ্যৎ যাতে পদ বঞ্চিত ভিন্নমতের শিক্ষকরা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হলেও অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করতে না পারে সেই অসৎ উদ্দেশ্যে অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য ১৫ বছর অথবা ১২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য ৫ বছরের এবং উপাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য ৩ বছরের সহকারী অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে সংযোজন করে বিগত ২৮-০৩-২১ তারিখে পুনরায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও নীতিমালা-২০২১ জারি করে, যা এখনো বিদ্যমান থাকায় উপরিউক্ত বর্ণনা মতে পদ বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার শিক্ষকরা জুলাই বিপ্লবের পরও সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হলেও তাদের চাকরিকাল ১৫-১২ বছরের স্থলে ২০-২৫ বছরের অধিক শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তারা উপাধ্যক্ষ/অধ্যক্ষ পদে আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
খ) বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োগকৃত উপাধ্যক্ষরাই অধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগ পাবে:
পতিত সরকারপন্থি অপেক্ষাকৃত জুনিয়র শিক্ষকরা অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সুযোগ পাচ্ছে শুধু জনবল কাঠামো-২০২১ বদৌলতে। বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী উপাধ্যক্ষ হিসেবে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই তারা শুধু অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভের জন্য আবেদন করতে পারবে। অর্থাৎ পতিত সরকারের নিয়োগকৃত উপাধ্যক্ষরাই অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাবে, যা জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থা।
গ) বিদ্যমান জনবল কাঠামোর বৈষম্যমূলক অনুপাত প্রথা:
জনকাঠামো অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য অনুপাত (৫ঃ২) প্রথার কারণে পুরাতন ডিগ্রি কলেজসমূহের অনেক অভিজ্ঞ সিনিয়র শিক্ষকের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ২০-২৫ বছরের অধিক হওয়ার পরও তারা যথাসময়ে বর্ণিত পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বিধায় সেসব অভিজ্ঞ সিনিয়র শিক্ষকরা বিদ্যমান ২০২১ সালের জনবল কাঠামোতে সংযোজিত বর্ণিত বিধি অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক পদে প্রযোজ্য ৩-৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকায় অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
ঘ) বিদ্যমান জনবল কাঠামোর উপহার দুর্বল শিক্ষা প্রশাসন :
উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের জন্য অধ্যক্ষ পদে ৩ বছরের সহকারী অধ্যাপক পদের অভিজ্ঞতা থাকা, ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে ৩ বছরের সহকারী অধ্যাপক পদের অভিজ্ঞতা থাকা এবং অধ্যক্ষ পদে ৩ বছরের উপাধ্যক্ষ পদের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১০ এ অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে ৩ বছরের সহকারী অধ্যাপক পদে অভিজ্ঞতা থাকাসহ যথাক্রমে ১২ ও ১৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা উল্লেখ ছিল, যা সর্বজন নন্দিত ছিল। নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে ২০-২৫ জন প্রার্থী উপস্থিত থাকত। অথচ বর্তমান নীতিমালার কারণে ০২/০৩ এর বেশি যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে নিয়োগ পরীক্ষাই নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলতেছে। এ কারণে শিক্ষা প্রশাসন দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো-২০২১ সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও কার্যকর করার পথ সুগম হবে। সর্বোপরি এই জনবল কাঠামোর সংস্কার বঞ্চিত কলেজ শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক দাবি পূরণের মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূলনীতি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ অর্থবহ ও কার্যকর হবে।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ
প্যানেল