ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি

শান্তির বার্তা নাকি পশ্চিমাদের ভিন্ন কৌশল

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ১৮:২৯, ৪ জুলাই ২০২৫

শান্তির বার্তা নাকি পশ্চিমাদের ভিন্ন কৌশল

গত ২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ইসরাইলি সরকার গত ১৩ জুন ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক ইরানে ব্যাপক আগ্রাসন শুরু করে কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার এবং কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করে। তাছাড়া ইরানের বিভিন্ন প্রদেশের সামরিক, পারমাণবিক, বেসামরিক অবকাঠামো এবং আবাসিক ভবনগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালায় ইসরাইল। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সারের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১৩ জুন ইরানে প্রথম হামলা করার দিন পর্যন্ত গাজা ও অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানে প্রায় ৩৫ হাজার হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ বলেছিলেন, আমরা খামেনিকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা করার যথাযথ সুযোগ পাওয়া যায়নি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন সময় বলেছিলেন, এই যুদ্ধ ইরানে সরকার পরিবর্তনের পথ তৈরি করতে পারে। ইসরাইলি হামলার জবাবে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী তেলআবিবে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইসরাইলে ইরানের হামলার কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করে আমেরিকার ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, এত বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র এমনভাবে ছোড়া হয়েছে, যেটি ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চাপে ফেলেছে। দুই দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। তবে ইরান হামলার আগে অন্তত কিছু সেন্ট্রিফিউজ তথা পারমাণবিক সরঞ্জাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতারের দোহায় অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান ‘অপারেশন গ্ল্যাড টিডিং ভিক্টরি’ পরিচালনা করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি ঘাঁটিতে ৪০ হাজার সৈন্য রয়েছে। ইরান আগে থেকেই বলে আসছিল, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলা চালায়, তাহলে এসব ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করা হবে। বাস্তবে হলোও তাই। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৬২৭ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৮৭০ জন আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো একটি পত্রে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি ইরানে মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থাপিত ব্যাখ্যাকে আইনিভাবে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে অবৈধ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন। জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় আত্মরক্ষার অধিকার দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনে হত্যা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাধারণ সম্মেলনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যে কোনো ধরনের হামলা কিংবা হামলার হুমকি আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সংস্থাটির বিশ^াসযোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করে। ইরানের যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আইন বৈধতা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাযা কাল্লাসও প্রশ্ন তুলেন। যে কেউ বলপ্রয়োগ করলে তাকে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে ন্যায়সংগতভাবে তা ব্যাখ্যা করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছিলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায্য হামলা বিশ^কে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ২৪ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রুশ কূটনীতিক ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেছেন, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বোমা তৈরির পরিকল্পনার মিথ্যা অভিযোগ করেছে। হামলার অজুহাত হিসেবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে তারা ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ বলে তিনি নিন্দা করেন। তারা তেজস্ক্রিয় দূষণের একটি বাস্তব হুমকি তৈরি করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, পাকিস্তান, ভারত, ইসরাইল এবং উত্তর কোরিয়া এই ৯টি রাষ্ট্রের নিকট পরমাণু অস্ত্রও রয়েছে।  
বহু বছর ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। পশ্চিমা বিশে^র কাছে এটি সম্ভাব্য অস্ত্রায়নের হুমকি। তবে ইরানের দৃষ্টিতে এটি একান্তই পরিচয়, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ২০১৫ সালে ইরান পারমাণবিক চুক্তি সই হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সীমিত করা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে এ চুক্তি থেকে সরে এলেও দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে ইসরাইলের হামলার কারণে ইরান আলোচনা থেকে সরে আসে। রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালে সই হওয়া ইরান পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি আরও বলেন, উত্তেজনা হ্রাস বা হামলা বন্ধ হওয়া একটি প্রয়োজনীয় শর্ত, যাতে ইরান ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বা আলোচনায় ফিরতে আগ্রহ দেখায়। যদিও ইরান বলছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র চায় না, তবু বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই প্রযুক্তি ইরানের আঞ্চলিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে। বিশেষত ইসরাইল যখন নিজে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং আন্তর্জাতিক নজরদারির বাইরে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করে আসছে, ইরান বহু বছর ধরেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে এবং বর্তমানে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে হলে ৯০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) গত মার্চ মাসে জানিয়েছে, ইরান এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশের মতো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ইরান দাবি করে আসছে, তারা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো শান্তিপূর্ণ কাজের জন্যই পরমাণু সমৃদ্ধকরণ করছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাৎজ বলেছেন, যদি দেখা যায় ইরান আবার পারমাণবিক কর্মসূচি সমৃদ্ধ করছে, তাহলে ইসরাইল নতুন করে হামলা চালাতে পারে। তবে তিনি এটিও বলেন যে, আমি এমন কোনো পরিস্থিতি দেখি না, যেখানে ইরান আবার তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পুনর্গঠন করতে পারবে। 
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘাঈ মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সামরিক আগ্রাসনের প্রশংসা করায় ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটেকে এসমাইল বাঘাঈ কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি বিশেষভাবে জঘন্য আগ্রাসনকে অভিনন্দন জানানো ন্যাটো মহাসচিবের জন্য লজ্জাজনক, নিন্দনীয় ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের প্রধান জেনারেল ড্যান কেইন বলেছেন, ইরানে পরিচালিত ‘অপারেশন মিডনাইট হামার’ ছিল ১৫ বছরের কাজের চূড়ান্ত পরিণতি। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে ন্যাটো সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেন, ইরান সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কারণে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে পেন্টাগনের একটি গোয়েন্দা পর্যালোচনায় বলা হয়েছিল, ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা দেশটির পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি এবং সম্ভবত এটি কয়েক মাস পিছিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, ইরানি জনগণ তাদের ঐক্য প্রদর্শন করেছে। ট্রাম্প ইরানকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইরানের মতো একটি মহান দেশ ও জাতির জন্য আত্মসমর্পণের কথা বলাই অপমানজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন। ট্রাম্প তাদের পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়ার যে দাবি করেছেন তা সত্য নয়। আমাদের পারমাণবিক অবকাঠামোর বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছুই অর্জন করতে পারেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ নতুন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। নেতানিয়াহু বলেছেন, এই যুদ্ধের ফলাফল এখন আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তির সুযোগ তৈরি করেছে। কোনো কোনো কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থামাতে চায়নি, বরং একটি যুদ্ধ উত্তেজনা পরিস্থিতি তৈরি করে নিজের সামরিক উপস্থিতি ও আধিপত্য জাহির করতে চেয়েছে। 
ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ইসরাইলি আগ্রাসনের মধ্যে ঐক্য ও প্রতিরোধ ধরে রাখার জন্য ইরানবাসী গর্বিত হওয়ার যোগ্য। দেশে যে মূল্যবান ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি জাতীয় সম্পদ। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। তিনি আরও বলেন, ইরান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহাবস্থানে দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করে। ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা মুসলিম ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সেবায় নিয়োজিত। আঞ্চলিক দেশগুলোর সতর্কতা ও প্রজ্ঞা-এই দুটি গুণই শত্রুদের বিভাজনমূলক চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিতে পারবে। ইরানের সংসদ জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার একটি বিল অনুমোদন করে। এতে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে আইএইএর পক্ষ থেকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় কোনো পরিদর্শন করতে চাইলে তা সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে। পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত থাকবে। তবে জাতিসংঘের আণবিক সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রসি বলেন, পরিদর্শকদের ইরানে ফেরত যাওয়া ও দেশটির সঙ্গে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। কূটনৈতিক সমাধানের একটি সুযোগ রয়েছে এবং সেই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে বিষয়টি খুব একটা সহজও হবে না। তিনি সতর্ক কবে বলেন, ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের প্রবেশে বাধা প্রদান করলে একটি নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ইরান যেহেতু পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্য, তাই আন্তর্জাতিক পরিদর্শন ব্যবস্থার আওতায় তাদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইরানসহ ১৯১টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করেছে। ইসরাইল, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া কিন্তু এনপিটি চুক্তির আওতাধীন না হলেও পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল এনপিটির সদস্য না হয়েও ইরানকে এনপিটির শর্ত মানতে বাধ্য করছে। 
ইরানের সংসদ স্পিকার বাকের কালিবাফ বলেন, আইএইএ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ইসরাইলের হামলার কোনো নিন্দা জানায়নি। তাদের নীরবতা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নিবিদ্ধ করেছে। এ কারণে আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এখন থেকে আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়া হবে, যদিও তা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই। ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেছেন, পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর হওয়া ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করছে ইরান। দেশটি তা পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা নিচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরাইল বলছে, তারা আঞ্চলিক শত্রু ইরানকে দুর্বল করেছে। আর ইরানের বক্তব্য হচ্ছে, তারা টিকে আছে এবং শক্তিশালী শত্রুদের পাল্টা জবাব দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি কূটিৈনতক প্রচেষ্টা চালাতে তুরস্ক, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান ভ্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ ইরানকে ভেঙে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের তেহরানে অবস্থিত সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক আব্বাস আসলানির মতে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানে তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় শক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া এবং সরকার পরিবর্তন করা। এক্ষেত্রে ইরান দক্ষ কুশলীর প্রমাণ রেখেছে। মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট বলেছেন, এই যুদ্ধের ফলে ইসরাইলের অর্জনের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। কারণ ইসরাইল এখন আর চাইলেও এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ছক আঁকতে পারবে না। ইসরাইল চেয়েছিল, ইরানকে গাজার মতো ধ্বংসস্তূপে রূপান্তর করতে। কিন্তু ট্রাম্পের যুদ্ধ থামানোর নির্দেশনায় নেতানিয়াহুর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে অংশ নিয়ে ট্রাম্প ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইলের কার্যকারিতা ও ধ্বংসক্ষমতার  প্রশংসা করেন এবং ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতির কথাও অকপটে স্বীকার করেন। ইরান এখন পর্যন্ত তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে। তবে ট্রাম্প বলছেন, ইরানের এ কর্মসূচিকে তিনি আবার চালু হতে দেবেন না। এমন দ্বন্দ্ব যদি বিদ্যমান থাকে, তাহলে আবারও পাল্টাপাল্টি হামলার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×