ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

ক্ষুদ্রঋণে বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি ও আগামীর জন্য কিছু পরামর্শ

শেখ আফনান বিরাহীম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১১:২৪, ৪ জুলাই ২০২৫

ক্ষুদ্রঋণে বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি ও আগামীর জন্য কিছু পরামর্শ

ছবি: জনকণ্ঠ

প্রায় পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশে জন্ম নেয় ক্ষুদ্রঋণ নামের এক যুগান্তকারী ধারণা। এই ক্ষুদ্রঋণ পরবর্তীতে সারাবিশ্বে তার নিজস্ব এক বিপ্লবের সূচনা করে। প্রতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা কোটি মানুষ এই ঋণের মাধ্যমে পায় আত্মনির্ভরতার পথ। ক্ষুদ্র ব্যবসা, গৃহস্থালির আয় এবং নারীর ক্ষমতায়নে এই ঋণের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু সংকট ও ডিজিটাল রূপান্তরের যুগে এই পুরনো মডেল কি এখনও ঠিক আগের মতোই কার্যকর?

বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। সাতশোরও বেশি নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) রয়েছে, যাদের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও আশা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে সারাদেশে তিন কোটির বেশি সক্রিয় ঋণগ্রহীতা রয়েছে।

বিশেষত নারীদের অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশের সাফল্য অনন্য। নব্বই শতাংশের বেশি ঋণ পায় নারীরা। ঋণভিত্তিক গোষ্ঠীগত সঞ্চয় ও সহায়তার মডেল সামাজিক মূলধন গড়ে তোলে। সেই সাথে বিকাশ-এর মতো মোবাইল ফাইন্যান্সের ব্যবহারের কারণে ঋণ প্রদান ও পরিশোধ এখন আগের চেয়ে অনেক দ্রুত এবং সহজ।

এই মডেল দরিদ্র মানুষদের নানা সংকট মোকাবেলা এমনকি সন্তানদের স্কুলে পাঠাতেও সহায়তা করেছে।

এই সাফল্যের পেছনে কিছু অদৃশ্য সংকটও জমে উঠেছে। ঋণের ফাঁদে পড়া এই ব্যবস্থাতে এখন আর বিরল নয়। এমনকি নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ শোধের প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ গভীর সংকটে পড়ে যান।

অনেক প্রতিষ্ঠানেরই সুদের হার অনেক এবং তা দরিদ্র মানুষের জন্য শোধ করা কষ্টকর। যদিও এই প্রক্রিয়াটি পুরো ব্যবস্থাকে চালু রাখতে প্রয়োজনীয়, তবুও অনেক ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘমেয়াদি লাভের বদলে ক্ষতিও করে থাকে।

এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ঋণগ্রহীতা বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে গেলেও কখনও মাঝারি বা বড় উদ্যোক্তায় পরিণত হতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে যেমন উপকূল, খরা-প্রবণ এলাকা প্রভৃতি স্থানে এই ঋণ মডেল কার্যকরভাবে খাপ খায় না।

তবুও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্র্যাক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণ, কিস্তিতে নমনীয় ব্যবস্থা এনে ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে ঋণ বিতরণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে।

এআই-ভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিং, বিকল্প তথ্য (যেমন মোবাইল ব্যবহার, বিদ্যুৎ বিল) দিয়ে ঋণ অনুমোদনের চেষ্টা হচ্ছে কিছু স্টার্টআপের মাধ্যমে। কিছু প্রকল্পে ঋণের পাশাপাশি গরু, ছাগল, অথবা প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীদের দীর্ঘমেয়াদি জীবিকা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

করোনাকালে কিছু প্রতিষ্ঠান ঋণ ফেরত স্থগিত করেছে এবং ঋণ ফেরতের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করেছে। এসব উদ্যোগ দেখিয়েছে, যদি ইচ্ছা ও উদ্ভাবন থাকে, তাহলে মডেলটিকে বিভিন্ন পরিস্থিতে খাপ খাওয়ানো সম্ভব।

আগামী দিনের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাকে হতে হবে আরও সংযুক্ত, অন্তর্ভুক্ত এবং সেই সাথে টেকসই। তাই সার্বিকভাবে যেসব সংস্কারের প্রয়োজন:

১. বিদ্যমান কেন্দ্রীয় ডেটাবেসের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণখাতে ইতোমধ্যে মাইক্রোফাইন্যান্স ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো নামক একটি কেন্দ্রীয় ঋণগ্রহীতা তথ্যভাণ্ডার রয়েছে, যা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর বাস্তব প্রয়োগ সীমিত। অনেক প্রতিষ্ঠান সময়মতো তথ্য আপলোড করে না, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দ্রুত ঋণগ্রহীতার তথ্য যাচাই করতে পারেন না। অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ঋণ বিতরণ হয়।
তাই শুধুমাত্র একটি ডেটাবেস থাকা যথেষ্ট নয়; এর ব্যবহারযোগ্যতা, দ্রুততার সাথে সঠিক তথ্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ঋণগ্রহীতা একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঋণ নিতে না পারে।

২. সুদের হার পুনর্বিবেচনা
বাংলাদেশে মাইক্রোক্রেডিটের বর্তমান সুদের হার অনেক ক্ষেত্রেই মূলধন সৃষ্টির চেয়ে ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য চক্রকে দীর্ঘস্থায়ী করে ফেলে। এই বাস্তবতায়, ধারাবাহিকভাবে ঋণ পরিশোধকারী বিশ্বস্ত গ্রাহকদের জন্য প্রণোদনা হিসেবে ধাপে ধাপে কম সুদের হার চালু করা যেতে পারে।
একইসঙ্গে ঋণচুক্তির সকল শর্তাবলী স্বচ্ছভাবে গ্রাহককে জানানো বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে তারা জেনেশুনে ঋণ নেন। সরকার বা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহায়তায় চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকিভিত্তিক বা সামাজিক-লাভভিত্তিক সুদ মডেল বিবেচনা করা যেতে পারে।

৩. প্রযুক্তি ব্যবহারে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা
ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমন মাইক্রোক্রেডিট খাতে ব্যাপক সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। মোবাইল ব্যাংকিং, অটোমেটেড ঋণ বিতরণ, এমনকি এআই-ভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিং প্রযুক্তি সবই ঋণ ব্যবস্থাপনাকে দ্রুত ও দক্ষ করেছে।
তবে এ প্রযুক্তির ব্যবহারে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা না গেলে তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি বঞ্চিত করবে। ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতা, এবং প্রযুক্তিভিত্তিক জটিল আবেদন প্রক্রিয়া দরিদ্র মানুষদের এক ধরনের ঝুঁকিতে ফেলছে।
তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি গ্রাহকদের উপযোগী প্রশিক্ষণ, সহজ মোবাইল অ্যাপ বা USSD ভিত্তিক লেনদেনব্যবস্থা এবং গ্রাহক সহায়তা লাইন চালু করা জরুরি।
এআই বা মেশিন-লার্নিং মডেল ব্যবহার করা হলেও, চূড়ান্ত ঋণ অনুমোদনে মানুষের দ্বারা পর্যবেক্ষণ বজায় রাখা প্রয়োজন যেন অযৌক্তিকভাবে কেউ বাদ না পড়ে।

৪. খাতভিত্তিক ও জলবায়ু সহনশীল ঋণ
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ততায় আক্রান্ত, উত্তরাঞ্চল খরাপ্রবণ, এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঘনঘন বন্যা দেখা দেয়। এই বাস্তবতায় একঘেয়ে ঋণপণ্যের পরিবর্তে খাতভিত্তিক এবং অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ ঋণপণ্য তৈরি করা দরকার।
যেমন, লবণাক্ততা সহনশীল ধান, চিংড়ি বা নোনা পানি মাছ চাষে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ ঋণ; বন্যা-পরবর্তী কৃষির পুনরুদ্ধারে স্বল্পসুদে কৃষিঋণ; পাহাড়ি অঞ্চলে বাঁশ বা জুম চাষের জন্য অনুরূপ ঋণ।
পাশাপাশি সৌর সেচ পাম্প, বায়োগ্যাস ইউনিট, জলবায়ু-বান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণেও সহায়তা করা যেতে পারে। নারীদের অনলাইনভিত্তিক হস্তশিল্প বা গিগ অর্থনীতির জন্যও আলাদা ঋণের ব্যবস্থা চালু করা গেলে নারী উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়বে এবং জীবিকায় বৈচিত্র্য আসবে।

৫. বৃহৎ অর্থনীতির সাথে সেতুবন্ধন
ক্ষুদ্রঋণের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো অধিকাংশ মাইক্রো উদ্যোক্তা বছরের পর বছর ক্ষুদ্র ব্যবসার পর্যায়েই থেকে যান। তাদের ব্যবসা কখনোই মাঝারি শিল্পে রূপান্তরিত হয় না।
এর পেছনে কারণ হলো আইনি জটিলতা, বাজারে প্রবেশাধিকার না থাকা, এবং বড় পরিসরে ব্যবসা পরিচালনার জন্য পুঁজি বা দক্ষতার অভাব। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার এবং এমএফআইগুলোকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
যেমন, ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া, আয়কর রিটার্ন ছাড় এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠতে পারলে বিশেষ কর অব্যাহতি বা ঋণ ছাড় সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
পাশাপাশি স্থানীয় বড় ব্যবসা বা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সাথে ক্ষুদ্র ব্যবসার যোগসূত্র তৈরি করে দিলে তাদের পণ্যের চাহিদা বাড়বে এবং তারা ধাপে ধাপে বৃহৎ অর্থনীতির অংশ হতে পারবে।

৬. স্বতন্ত্র প্রভাব নিরীক্ষণ
ক্ষুদ্রঋণের সফলতা বিচার করা শুধু পরিশোধের হার দিয়ে যথেষ্ট নয়। বাস্তবিক অর্থে কতটা মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারছে, তাদের আয় কতটা বেড়েছে, ঋণের সময় মানসিক চাপ কেমন, নারীর সামাজিক অবস্থানে কী পরিবর্তন ঘটেছে—এসব সূচকই প্রকৃত প্রভাব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।
তাই স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ প্রভাব মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় বা উন্নয়ন গবেষকরা এই মূল্যায়ন পরিচালনা করতে পারে।
এই মূল্যায়নগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে মাইক্রোক্রেডিট পণ্য ও কৌশল পুনর্বিন্যাস করা হলে তা আরও ফলপ্রসূ হবে। শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক ও মানবিক প্রভাবকেও বিবেচনায় এনে সামগ্রিক উন্নয়নের ধারায় ক্ষুদ্রঋণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

সামনের দিনগুলোতে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাকে এমন একটি কাঠামোতে তৈরি হতে হবে, যেটি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ঋণকে উন্নয়নের সিঁড়িতে পরিণত করে সূচনা করবে এক নতুন উন্নয়নযাত্রার।

মুমু ২

×