ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

আশুরা: রক্তে লেখা আখ্যান, আত্মশুদ্ধির অনন্ত আলোকরেখা

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশিত: ১০:২৩, ৪ জুলাই ২০২৫

আশুরা: রক্তে লেখা আখ্যান, আত্মশুদ্ধির অনন্ত আলোকরেখা

ছবি: সংগৃহীত

আশুরা—এ এক দিন নয়, যেন ইতিহাসের রক্তাক্ত পৃষ্ঠায় লেখা এক অনন্ত অধ্যায়, যার প্রতিটি অক্ষর জ্বলজ্বল করে আত্মত্যাগ, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর প্রেমে উদ্বেল হয়ে ওঠা অন্তরের ভাষায়। মহররমের দশম দিনটি মুসলিম হৃদয়ের এমন এক দীপ্ত মোমবাতি, যার আলোয় জেগে ওঠে কারবালার করুণ প্রতিচ্ছবি, যার শিখায় গলে যায় অন্যায়ের অভিজাত মুকুট, উন্মোচিত হয় সত্যের শ্রেষ্ঠতম সৌন্দর্য।

আল্লাহ যখন বললেন, “আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত,” তখন সেই সম্মানিত মাসগুলোর অগ্রভাগে ছিল মহররম। এর পবিত্রতা ছিল আদি থেকে, এবং চিরকাল থাকবে আত্মিক পরিশুদ্ধির উপাসনার প্রধান উপলক্ষ হয়ে। এই মাসের বিশেষ দিন আশুরা, যেখানে কেবল ঘটেনি ইতিহাস, বরং জন্ম নিয়েছে ঈমানের উত্তাপ, চোখের অশ্রু, হৃদয়ের ভ্রূকুটি।

মহররমের দশম দিনে, বহু নবী ও উম্মতের মুক্তির আখ্যান রচিত হয়েছে। নূহ (আ.) এর নৌকা অবতরণ করেছিল জুদী পর্বতে এই দিনে। মুসা (আ.) মুক্ত হয়েছিলেন ফিরআউনের নির্মম জুলুম থেকে। তখনকার ইয়াহুদিরা এই দিনে রোজা রাখত, স্মরণ করত মুক্তির আনন্দ। রাসূল (সা.) যখন মদিনায় আগমন করলেন, তিনি বললেন, “আমরাই তো মুসার প্রতি অধিক হকদার।” অতঃপর তিনি আশুরার রোজা পালন করলেন ও নির্দেশ দিলেন তার উম্মতকেও।

কিন্তু মদিনার পথ পেরিয়ে, একদিন ইতিহাস এসে থমকে দাঁড়ায় কারবালার প্রান্তরে। সেদিন—৬১ হিজরির মহররমের দশম দিন—ইসলামের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, ইমাম হুসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন সত্য ও ন্যায়ের রক্ষায়। তিনি চেয়েছিলেন বাতিলের বেদীতে সত্যের পতাকা নত না হোক কখনও। তাঁর দেহে ছিন্নবিচ্ছিন্ন তলোয়ারের আঘাতে লেখা হয়েছিল এক চিরন্তন বিজয়ের ইতিহাস।

তিনি হারাননি—তিনি জিতেছেন সেই মুহূর্তে, যখন তিনি বলেছিলেন, “আমার মৃত্যু আছে, তবে আমার পরাজয় নেই।” হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত আমাদের কেবল শোকের আবরণে মুড়ে দেয় না; বরং এক জাগরণ তৈরি করে আত্মার ভেতর। সে জাগরণ এমন, যা বলে—সত্যের পথে কেউ একা হলেও সে একাই একটি উম্মাহ।

কারবালার রক্তক্ষরা ভূমি ছিল নিছক রাজনীতির সংঘর্ষ নয়, ছিল ঈমানের বর্ণময় প্রতিচ্ছবি। হুসাইন (রা.) বেছে নিয়েছিলেন মৃত্যু, তবু মাথা নত করেননি ইয়াজিদের সামনে। কারবালা তাই এক কেবল যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং আদর্শের মহাবিপ্লব, যা বারবার আমাদের আত্মায় ধ্বনিত করে—বাতিল যতই জেঁকে বসুক, তাও সত্যের দীপ্তি নিভে যায় না।

রাসূল (সা.) আশুরার রোজা সম্পর্কে বলেন, “আমি আশাবাদী, এ রোজা এক বছরের পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করিয়ে দেয়।” এর মাঝে রয়েছে কেবল শারীরিক ত্যাগই নয়, বরং নফসের নিয়ন্ত্রণ, আত্মার তাওবা, চেতনার নবজন্ম।

আশুরা আমাদের কেবল অতীত স্মরণ করায় না, বরং বর্তমানকে শাণিত করে এবং ভবিষ্যতের দিকে ঈমানের দীপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে বলে। সে আমাদের বলে—যেখানে অন্যায়, সেখানেই আমাদের হোক হুসাইন-সুলভ প্রতিবাদ; যেখানে অন্ধকার, সেখানে জ্বলুক কারবালার দীপ্ত প্রদীপ।

এই দিন আমাদের চোখে আনতে পারে অশ্রু, কিন্তু তাতে যেন থাকে হৃদয়ের শুদ্ধতা। এই দিনে যদি বুকে আসে হাহাকার, তাও যেন হয় হক ও তাওবার ধ্বনিতে। আশুরা আমাদের আত্মার দরজায় কড়া নাড়ে—“হে মুমিন! তুমি কার পক্ষ নিচ্ছ? হুসাইনের না ইয়াজিদের?”

আশুরা আমাদের বলে—আল্লাহর পথে সত্যের সঙ্গেই থাকো, যদিও তা কঠিন, যদিও তা রক্তের বিনিময়ে আসে। তবু সেই পথেই আছে মুক্তি, আছে জান্নাতের সুগন্ধি বাতাস।

তাই হে মুমিন হৃদয়, এসো আজ আশুরার করুণায় কাঁদি, কিন্তু সেই কান্না হোক আত্মসংশোধনের অঙ্গীকার। এসো হুসাইনের আত্মত্যাগে উদ্ভাসিত হয়ে, আমাদের ভেতরের ‘ফেরাউনি’ মনোভাবকে গলাটিপে মারি। এসো, আত্মাকে জাগিয়ে তুলি মহররমের রোশনীতে, আর বলি—

“আমরা ইয়াজিদের পতাকা বহন করব না কখনও,
আমরা হুসাইনের শিরউন্নত চেতনায় বেঁচে থাকব যুগে যুগে।”

লেখক: জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
 

নোভা

×