আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে একটি বিস্তৃত সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এতে লেনদেন, কর ও শুল্কসংক্রান্ত দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা দূর করা এবং নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ীদের জন্য নগদ লেনদেনের সীমা শিথিল করা এবং আটটি পর্যন্ত নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ট্যাক্স রিটার্ন (পিএসআর) জমা দেওয়ার প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিবেচনাধিকার সীমিত করা। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যই গ্রহণ করতে হবে, ফলে ‘স্বেচ্ছাচারী মূল্যায়ন’-এর অভিযোগ করা থেকে মুক্তি পাবে ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছিলেন।
কর ব্যবস্থার বোঝা কিছুটা কমাতে এনবিআরের আরেকটি প্রস্তাবনা হলো ন্যূনতম করের আওতায় জমা দেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ভবিষ্যতের কর সমন্বয়ে ব্যবহার করার সুযোগ রাখা। এতে ব্যবসা কম মুনাফায় চললে আগের বেশি করের টাকা পরবর্তীকালে অফসেট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
বাজেট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক শীর্ষ কর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রস্তাবিত সংস্কারের লক্ষ্য হলো কর প্রশাসন সহজ করা, স্বচ্ছতা আনা এবং বিনিয়োগ ও ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যে জটিলতা আছে, তা বহুদিনের। এবার আমরা তার বাস্তব সমাধান খুঁজে পেতে বদ্ধপরিকর।
তিনি আরও জানান, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় ইতিবাচক সাড়া মিলেছে বলে জানা গেছে। আগামী দু’এক দিনের মধ্যে প্রস্তাবগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হতে পারে। অনুমোদন পেলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আগামী জুনেই তা কার্যকর করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, এসব সংস্কার নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তাদের মতে, প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে কর ও নিয়ন্ত্রণের জটিলতা অনেকটাই কমবে এবং একটি সহায়ক ব্যবসা পরিবেশ তৈরি হবে। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)-এর সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, কর ও শুল্ক নীতিতে এনবিআরের এই প্রগতিশীল ও দূরদর্শী পদক্ষেপ ব্যবসায়ী সমাজে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
নগদ লেনদেন সীমা শিথিলের প্রস্তাব ॥ বর্তমানে, কর্পোরেট কর হার ২৫ শতাংশে সীমিত রাখতে হলে কোম্পানিগুলোকে বছরে সর্বোচ্চ ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ লেনদেনের মধ্যে থাকতে হয়। এই সীমা অতিক্রম করলে অতিরিক্ত ২.৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। নীতিটির লক্ষ্য ছিল নগদবিহীন অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়া ও স্বচ্ছতা আনা।
তবে ব্যবসায়ীরা এই সীমাকে বাস্তবতাবিবর্জিত বলে মনে করেন। তাদের মতে, অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের এখনও অনেক লেনদেন নগদেই করতে হয়। দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য, এই সীমা কার্যত অধিকাংশ কোম্পানিকেই বাড়তি কর দিতে বাধ্য করছে।
এছাড়া কোম্পানিগুলোকে কর্মচারীদের বেতন বা পরিবহন খরচ নগদ অর্থে প্রদান করতে এবং কাঁচামাল কিনতেও ৫০ হাজার টাকার বেশি নগদ খরচ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই সীমা অতিক্রম করলে কর ছাড় পাওয়া যায় না এবং নিয়মিত হারে কর দিতে হয়। বহুদিন ধরে ব্যবসায়ী ও কর বিশেষজ্ঞরা এই কঠোর নিয়মের সমালোচনা করে আসছেন।
এনবিআরের সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন বাজেটে নগদ লেনদেনের সীমা বার্ষিক টার্নওভারের নির্দিষ্ট শতাংশের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা হতে পারে। যেমন মোট আয়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ লেনদেন অনুমোদন দেওয়া।
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে যেখানে এখনো নগদের ওপর নির্ভরতা বেশি, সেখানে সবার জন্য একই সীমা বাস্তবসম্মত নয়। সদ্য রেজিস্টারভুক্ত বা কর ছাড়প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও আইটিইএস কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলের বাধ্যবাধকতাও বাস্তববিরোধী। তিনি আরও বলেন, ‘ডিজিটাল লেনদেন বাধ্যতামূলক করার আগে চার বছরের একটি রূপান্তরকালীন চালু করলে তা আন্তর্জাতিকমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ন্যায্য হবে। নগদ লেনদেনে সীমা, পিএসআর (ট্যাক্স রিটার্নের প্রমাণ) ও শুল্ক মূল্যায়ন পদ্ধতির শর্তাবলী সংস্কারের দাবিকে ধারাবাহিকভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা।
নির্বিচারে শুল্ক মূল্যায়ন বন্ধের সম্ভাবনা ॥ বর্তমানে শুল্ক কর্তৃপক্ষ অনেক সময় আমদানিকারকের ঘোষণাকৃত মূল্যকে অগ্রাহ্য করে পণ্যের দাম বেশি করে নির্ধারণ করে। এনবিআর মূলত ভুয়া ঘোষণা ও আন্ডার-ইনভয়েসিং ঠেকাতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
তবে এতে প্রকৃতপক্ষে কম দামে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য কৃত্রিমভাবে বেড়ে যায়, যার ফলে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে এবং তা ভোক্তাদের ওপর চাপ ফেলে। একই সঙ্গে এটি অর্থপাচারের ঝুঁকিও বাড়ায়।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃত আমদানি মূল্যের ভিত্তিতে শুল্ক মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও এনবিআরের নির্বিচারে মূল্যায়ন অনুমোদিত, তবে সম্ভাব্য রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কায় এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
গত মাসে এক প্রাক-বাজেট বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, যেন তারা ঘোষিত দামের ভিত্তিতে মূল্যায়নের একটি কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
এনবিআরের কাস্টমস শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগামী অর্থবছর থেকে ঘোষিত মূল্যের ভিত্তিতে মূল্যায়নের জন্য দেশের সব কাস্টমস হাউসকে নির্দেশ দেওয়া হবে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এতে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, ভুয়া ঘোষণা ঠেকাতে এখনো কার্যকর কৌশলের ঘাটতি রয়েছে।
জাভেদ আখতার বলেন, শুল্ক মূল্যায়ন অবশ্যই প্রকৃত লেনদেন মূল্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। স্বেচ্ছাচারী মূল্যায়নের প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঘোষিত মূল্য যাচাই করতে এনবিআরকে আন্তর্জাতিক মূল্য তথ্যভা-ারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্র জানায়, উচ্চ আদালত ধারাবাহিকভাবে আমদানিকারকদের পক্ষে রায় দিয়েছেন এবং ঘোষিত মূল্যের ভিত্তিতে মূল্যায়নের বৈধতা নিশ্চিত করেছেন।
স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সুপ্রতিষ্ঠিত মূল্যায়ন নীতি অনুসরণ করলে এ ধরনের বিরোধ অনেকটাই কমে আসবে। এতে মামলা কমবে, বাণিজ্য সহজ হবে এবং আইনি জটিলতাও হ্রাস পাবে।
ন্যূনতম কর সমন্বয়ের সুযোগ ॥ এখন কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী বার্ষিক টার্নওভারের ০.৬ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ন্যূনতম কর দিতে হয়, যা ফেরতযোগ্য নয়। ফলে, লোকসানে গেলেও তাদের কর দিতে হয়। এতে বিশেষ করে প্রান্তিক মুনাফার কোম্পানিগুলোর ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।
বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করহার ২০ থেকে ২২.৫ শতাংশ, আর তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির জন্য তা ২৭.৫ শতাংশ। মোবাইল ফোন ও তামাক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে করহার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
তবে ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, ন্যূনতম ও অগ্রিম কর সমন্বয়ের সুযোগ না থাকায় কার্যকর করহার প্রায়ই ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি হয়। লোকসানে থাকা কোম্পানির জন্য এটি মূলধনের ক্ষয় ডেকে আনে, যা আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের বাজেটে এমন একটি বিধান আসতে পারে, যাতে কোম্পানিগুলো ন্যূনতম বা অগ্রিম কর হিসেবে পরিশোধ করা অতিরিক্ত অর্থ ভবিষ্যতের করযোগ্য আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারবে। জাভেদ আখতার বলেন, নন-রেসিডেন্ট কোম্পানির জন্য উচ্চ করহার এফডিআইয়ে বাধা সৃষ্টি করে। তাই এফআইসিসিআই চায় উৎসে কর কর্তন ও ন্যূনতম করহার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হোক, যাতে রাজস্ব আদায় ও ব্যবসায়িক খরচের ভারসাম্য বজায় থাকে।