
ছবি: সংগৃহীত
এটা কয়েক বছর আগের কথা, তখন আমি অনার্সে পড়ি। মাঝে মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী–র রক্তদান কর্মসূচিতে অংশ নিতাম। সেই সুবাদে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের কিছু ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তীতে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরা সবাই ভবিষ্যতের ডাক্তার।
ছোটবেলায়, ফরিদপুর জেলা স্কুলে পড়াকালীন প্রায়ই মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্টিনে গিয়ে আড্ডা দিতাম। তখনো বুঝিনি এই জায়গাগুলো একদিন স্মৃতির খাতায় এক বিশেষ জায়গা করে নেবে। মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখতাম, যদি আমিও ডাক্তার হতে পারতাম! কিন্তু পড়াশোনায় তেমন ভালো না হওয়ায় সেই স্বপ্নটা ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে।
তবুও, মেডিক্যালে পড়ুয়া বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কটা ধরে রেখেছিলাম। এখন ওদের অনেকেই নামকরা ডাক্তার। কিন্তু আমি আজো ভুলতে পারিনি সেই একদিনের 'ভিক্ষার' অভিজ্ঞতা—এক ব্যতিক্রমী দিনের কথা, যেদিন আমি আর আমার ডাক্তারি পড়ুয়া বন্ধুরা রাস্তায় নেমেছিলাম মানুষের সাহায্যের আশায়।
একদিন আমার কিছু বন্ধু আমাকে বলল, “রুবেল, আজ আমরা গরিব-অসহায় মানুষের জন্য ভিক্ষা করব। তুই কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকবি।” প্রথমে একটু চমকে গেলেও রাজি হয়ে গেলাম। জানতাম, এরা যেহেতু আছে, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো মানবিক উদ্দেশ্য আছে।
একটি ভ্যান যোগাড় করা হলো। আলীপুর এলাকা থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। কয়েকটি বাড়ি থেকে পুরনো কাপড় পেলাম, কেউ কেউ কিছু টাকা দিল। সেই সময় দেশের কিছু অঞ্চল বিশেষ করে ফরিদপুর অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল। আমাদের এই ‘ভিক্ষা অভিযান’ ছিল সেই বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য।
ঘটনাটা আরও স্মরণীয় হয়ে ওঠে একটি বাড়িতে গিয়ে। আলীপুরের খাঁ পাড়ার একটি সুন্দর বাড়িতে যখন পৌঁছাই, তখন আমাদের দলের অন্যতম বন্ধু ছিলেন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের মেধাবী ছাত্র, কলেজের দ্বিতীয় স্থান অধিকারী। দরজায় একজন আন্টি এলেন। আমরা বললাম, “আন্টি, গরিব মানুষের জন্য কিছু সাহায্য চাই।”
আন্টি প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “এখনকার ভালো ঘরের ছেলেরাও চাঁদাবাজিতে নেমেছে!” এরপর আঙ্কেলকে ফোন করে বললেন, “কিছু বখাটে ছেলে এসেছে চাঁদা চাইতে।” ফোনে আমাদের নাম-ঠিকানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাইলেন। আমরা সবাই নিজেদের পরিচয় ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বলায় কিছুটা থেমে গেলেন।
অবশেষে আন্টি একটু হেসে বললেন, “বাবা, বসো, তোমাদের জন্য কিছু আনছি।” ভয় হচ্ছিল, পুলিশ ডাকা হচ্ছে না তো? কিন্তু না—তিনি ফিরে এলেন কিছু পুরনো ও নতুন কাপড় আর ২০০০ টাকা নিয়ে। বললেন, “তোমাদের আঙ্কেল একজন ডাক্তার। ফরিদপুর মেডিক্যালে যিনি শিক্ষক। তোমরা তার ছাত্র! এভাবে মানুষের জন্য কিছু করছ, গর্বিত হচ্ছি তোমাদের জন্য।”
আমরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম। সত্যিই তো—ভালো কাজের মর্যাদা একদিন না একদিন ফেরত আসেই। সেদিন আমাদের সংগ্রহে আরও কিছু জামা-কাপড় ও টাকা যুক্ত হলো, আর আমরা বুঝলাম—মানবিকতার পথ কখনো ফাঁকা পড়ে না।
বিঃদ্রঃ
আমার ডাক্তার বন্ধুদের অতীতের সেই মানবিক স্মৃতিটুকু এখানে তুলে ধরলাম। জানি, তোমরা এখনো নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে আছো। তোমাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন।
এসএফ