
ছবি: সংগৃহীত
বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। বাবা মারা গেছেন বছর খানিক। কেউ আমাদের দায়িত্ব নেয় নি। তাই আমাদেরই অন্দরমহল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয় জীবিকার প্রয়োজনে। বাবা বেঁচে থাকতে আমাদের পর্দার সম্ভ্রমে কখনো কোনো আঘাত লাগে নি। আমাদের দুই বোনের এবং মার কখনো পর্দার খেলাফ হতে দেন নি বাবা। পুরো এলাকার কেউ আমাদের দেখতে পায় নি।
আমাদের জীবনটাও ছিলো অত্যন্ত সুন্দর। কিন্তু আচমকা বাবার মৃত্যু যেনো আমাদের জীবনে দুঃখের বন্যা এনে দিলো। কোনো আত্মীয় স্বজন এমনকি আমাদের বাবা যাদের নিয়মিত সাহায্য সহযোগিতা করতো তারাও কখনো উকি মেরেও দেখে নি আমাদের। আমাদের রক্তের সম্পর্কের চাচারাও না।
আমরা বেঁচে আছি কি মরে গেছি এতে তাদের কিছু যায় আসে না। বাড়িতে থাকা সমস্ত কিছু যখন একবারে ফুরিয়ে গেলো, আমার মাকে না চাইতেও বাড়ির বাইরে পা রাখতে হলো।এদিকে চাচারা জমি জমার ভাগাভাগি করে আমাদেরকে বঞ্চিত করে দিলো। এমনকি বাবার ফসলের জমিটাও তারা নিজের নামে নিয়ে নিলো। শুধু পড়ে রইলো বসত ভিটে খানি।
মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাওনা টাকা আদায় করতে বের হলেন। কেউ টাকা ফেরত দিলো না। মাকে দেখতাম মোনাজাত তুলে অঝোরে কাঁদছেন। তিনি কখনো ভাবেন নি তাকে মানুষের বাড়ি গিয়ে টাকা চাইতে হবে। কিছু করার নেই বেঁচে থাকতে হলে তাকে কিছু করতেই হবে।
আমার মামারা সবাই সৎ। আমার মা কারো সামনে কথা বলতে পারেন না।
তিনি কয়েকজনের বাড়ি গিয়ে মহিলা সদস্যদের নিচু গলায় পাওনা টাকা ফেরত দিতে বলতেন, যে টাকাগুলো তাদের স্বামীদের বিপদে আমার বাবা ধার দিয়েছিলেন। অদ্ভুত রকমভাবে সবাই আমার মাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিলো। কয়েকজন তো টাকা ধারের বিষয়টি অস্বীকার করলো।
কিন্তু আল্লাহ আমাদের উপর মুখ ফরিয়ে নেন নি। খুব শীঘ্রই মা তার গহনাগুলো বিক্রি করলেন। সেগুলো দিয়ে দুটো গাভী এবং হাঁসমুরগি কিনলেন। এভাবেই একভাবে আমাদের এক বেলা ভাতের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। মা দোয়া করছেন, আমার যেনো দ্রুত কোনো নেককার ইনসানের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। অন্তত এভাবে আমি তো ভালো থাকবো।
দুই বোনের পরার জন্য জামা প্রয়োজন, তাই মার্কেটে আসা। কিন্তু আমরা জীবনে কখনো এমন জনবহুল পরিবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা এক পা আগায় তো দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। পুরুষ মানুষ চলে গেলে এরপর আবার আগায়। আমার চোখ পানিতে ভরে যাচ্ছিলো। আহ কি দুরবস্থা আমাদের। সত্যি বলতে এ যেনো এক জাহান্নাম। পারছিলাম না আর সহ্য করতে। ভাবছিলাম আমার মা কীভাবে বাজার করেন? আমি শুধু একদিন মার সাথে বের হয়ে এ অবস্থা। আমার মা তো আরো নমনীয় এবং সহজ সরল মানুষ সে কতো না কষ্ট করে এসবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন শুধু আমাদের কথা ভেবে। আজ যদি বাবা বেচে থাকতেন তাহলে হয়তো এসব কিছু সহ্য করতে হতো না। বাবা আমাদের সম্ভ্রমে এক ফোটা আঁচড়ও লাগতে দিতেন না।
বুঝতে পারলাম দোকানদার আমাদের সহজ সরল পেয়ে অধিক দাম হাঁকছেন। কিছু দোকানদার আমাদের ব্যাকডেটেড ভাবছেন, আপনারা তো কাপড়ই চিনেন না, জানেন এর দাম কত? এগুলো কি এখনো কেউ পরে? ইত্যাদি বলে অপমানও করলেন। খুব কষ্টে দুটো জামা কিনে আনলাম, দোকানদার আমাদের অধিক পরিমাণে ঠকিয়ে দিয়েছেন তাও হয়তো বুঝতে পারি আমরা কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের কথা বলার ও সাহস নেই। আমরা এসবে অভ্যস্ত নই।
জীবন আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। প্রতিটা রাত আমার আর মার ঘুমহীন কাটে। না জানি কখন কে এসে কোন বিপদ ঘটিয়ে ফেলে। আমরা বুঝতে পারি সবার কুনজর আছে আমাদের দিকে।
মা যখন আল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলেন আমাদের দুই বোনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ে।সত্যি বলতে অন্তরের অন্তস্থ থেকে বলছি আমাদের সাথে এতো কিছু হওয়ার পরও আমরা কখনো আমাদের মাকে আল্লাহর উপর একটি অভিযোগ আনতে দেখি নি।
মা সব সময় বলেন আমাদের সাথে যা কিছুই হোক না কেনো তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছে। অবশ্যই আল্লাহর কোনো পরিকল্পনা আছে। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে।মনে রাখতে হবে আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না।
ফারুক