
ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিকতা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি দায়িত্বপূর্ণ এবং আলোকচিত্রের শক্তি অপরিসীম— এমন মন্তব্য করেছেন ইস্তানবুল ফটো অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫–এর ‘ডেইলি লাইফ’ বিভাগে পুরস্কারজয়ীরা।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলুর আয়োজনে পরপর ১১তম বছরের মতো অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় ১০টি বিভাগে মোট ২৯ জন আলোকচিত্রী পুরস্কার লাভ করেছেন। এবারের আয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জমা পড়েছে প্রায় ২২ হাজার ছবি। গত এক দশকে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন ২০ হাজারের বেশি আলোকচিত্রী, যা এর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা প্রতিফলিত করে।
হাইতির সংকট তুলে ধরে সম্মান পেলেন ফাবিও বুকিয়ারেলি
ইতালির ‘লা রেপুবলিকা’ পত্রিকায় কর্মরত আলোকচিত্রী হাইতির রাজনৈতিক বিপর্যয় ও সশস্ত্র গ্যাং সহিংসতার মাঝেও মানবিক সংকটের চিত্র তুলে ধরে ‘স্টোরি ডেইলি লাইফ’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ফাবিও বুকিয়ারেলি।
তিনি আনাদোলুকে বলেন, ‘পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যমের জন্য হাইতি একপ্রকার অদৃশ্য। অথচ সেখানে বর্তমানে যে মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা বিশ্বে অন্যতম ভয়াবহ।’
বুকিয়ারেলি জানান, হাইতিতে কাজ করতে গিয়ে তাকে পড়তে হয়েছে নানা বিপদের মুখে—রাস্তা ব্লকেড, স্নাইপারের গুলি, অস্থায়ী চেকপোস্ট এবং দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগসহ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা।
‘ধৈর্য, শ্রদ্ধা ও গভীরতার সাংবাদিকতা প্রয়োজন’
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা এমন এক সময় পার করছি, যেখানে সংবাদ পরিবেশনের গতি ও তাৎক্ষণিকতা অনেক সময় এর গভীরতাকে ধ্বংস করে দেয়। আমি এমন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করি, যেখানে সময় লাগে— মানুষের গল্প শোনার জন্য, সংস্কৃতি বোঝার জন্য, এবং তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে উপস্থাপন করার জন্য।’
বুকিয়ারেলির ভাষ্য, ‘সত্যিকারের পরিবর্তন আসে তখনই, যখন আমরা চটকদার গল্প নয়, বরং জটিল বাস্তবতা গভীরভাবে তুলে ধরি।’
পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই স্বীকৃতি আমাকে সুযোগ করে দিচ্ছে আমার বলা গল্পগুলোর বার্তা আরও দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।’
তিনি আরও জানান, ২০২১ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর জন্য ইতালিতে কোভিড-১৯ এর তথ্যচিত্র তুলে ধরে তিনি প্রথম পুরস্কার পান। এরপর থেকেই তিনি ইস্তানবুল ফটো অ্যাওয়ার্ডস–এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আছেন, যা এক ধরনের সহায়তামূলক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
যুদ্ধের মাঝেও জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে সম্মান পেলেন সামির আল-দুমি
সিরিয়ার হোমস শহরে যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় একটি পরিত্যক্ত ট্যাংকের সামনে এক ফল বিক্রেতার ছবি তুলে ‘মেরিয়ন মার্টেন্স সিঙ্গেল ডেইলি লাইফ’ বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন সামির আল-দুমি, যিনি ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপি’র হয়ে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে দীর্ঘ সময় নির্বাসনে থাকার পর আবার নিজের দেশে ফিরে ক্যামেরা হাতে নেওয়া আমার জন্য এক অদ্ভুত, আবেগঘন অভিজ্ঞতা ছিল।’
হোমসে পৌঁছাতে তাকে ৬ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। দেশটির অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্ভর করতে হয়েছে কেবল তার অভিজ্ঞতা ও প্রবৃত্তির ওপর।
তিনি বলেন, ‘ছবিটি শুধু একটি মুহূর্ত নয়, বরং প্রতিরোধ, অভিযোজন আর নীরব প্রতিবাদের গল্পও বলে। ধ্বংস আর জীবনের প্রতীক—দুটো এক ফ্রেমে ধরা পড়েছে।’
‘সংবাদচিত্র ইতিহাসের এমন এক দলিল, যেটি মুছে ফেলা যায় না’
আল-দুমি বলেন, ‘সংবাদচিত্র এক অনন্য মাধ্যম—যা নির্যাতনের শিকার মানুষের বাস্তবতা বিশ্বকে দেখায়। কখনও তাৎক্ষণিক পরিবর্তন না আনলেও, এটি শিক্ষাদান করে, সচেতনতা বাড়ায় এবং ইতিহাস সংরক্ষণ করে।’
এই পুরস্কার তার কাছে আরও তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ায় ফিরে আসার পর তার প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও যে যুদ্ধের ক্ষতির শিকার, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষের গল্প বলা আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। এই ছবিটি আমার হৃদয়ের খুব কাছের।’
বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও মানবিক ইস্যুগুলো তুলে ধরার অন্যতম মঞ্চ হয়ে উঠেছে ইস্তাম্বুল ফটো অ্যাওয়ার্ডস। প্রতিযোগিতাটি এবছর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে তুর্কসেল (যোগাযোগ অংশীদার), তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা (বিদেশি আয়োজন অংশীদার) এবং তুর্কিশ এয়ারলাইন্স (এয়ারলাইন অংশীদার)–এর।
সূত্র: আনাদোলু।
রাকিব