ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

সোনালি অতীত 

কাজী মো. ইসমাঈল হোসেন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১২:২৫, ২৭ জুন ২০২৫

সোনালি অতীত 

অতীতের সেই দিনগুলো ফিরে আসে না, কিন্তু সেই স্মৃতি গুলো ফিরে আসে। সময়ের পেছনে ফেরা সম্ভব নয়, তবে  স্মৃতির জানালায় বারবার উঁকি দেয়।

আমাদের অতীতে ছিলোনা যান্ত্রিকতা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা। তাই বুঝি আমাদের অতীত ছিলো সবচেয়ে নির্ভেজাল ও আনন্দময়।বর্তমান সময় বড্ড যান্ত্রিক ও আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ।যা উপভোগ্য নয়। কিছুদিন আগের ঘটনা, পাশের গ্রামে প্যান্ডেল দেখে ভাবলাম বিয়ের অনুষ্ঠান।পরে জানতে পারলাম বাচ্চার খতনার জন্য বাড়িতে প্যান্ডেল বানিয়ে গায়ে হলুদ করছে, ক্ষীর খাওয়ানোর আয়োজন করছে, খতনার আগের রাতে 'মৌ-লোভী' এনে মিলাদ মাহফিলও করছে।

অথচ আমাদের সময় আমাদের বেলা মনে পড়ে বাংরি এসে পা দুটোকে চেপে ধরে 'লালপাখি'র লোভ দেখিয়ে কচ করে কেটে হাওয়া হয়ে যেত। এরপর গামছা পরে কাটাতাম বেশ কয়েকদিন। ব্যাস। আমাদের স্মৃতি ছিলো কতো মধুর।কত্ত খেলাধুলা করতাম।ধুলি,কাঁদা মাখা এক্কা দোক্কা খেলতাম। অথচ বর্তমান বাচ্চাদের দেখলে মনে হয় যেন কর্পোরেট অফিসার। প্রকৃতির হওয়া বাতাস থেকে তারা বঞ্চিত। 

আমার অতীত ছিলো সবার থেকে আলাদা

কিছু স্মৃতি :
১.একবার কিছু সেনাবাহিনীর গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।আমরা তিন জন রাস্তায় দাড়িয়ে ছিলাম। প্রসঙ্গ উঠলো সেনাবাহিনীর টুপি নিয়ে।একজন বললো সেনাবাহিনীর টুপি লোহার তৈরি, আর একজন বললো আরে নাহ্, সেনাবাহিনীর টুপি প্লাস্টিকের তৈরি। আর আমি বললাম সেনাবাহিনীর টুপি মখমলের কাপরের তৈরি।
তর্কে রায় দিতে গিয়ে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, তা ছিলো হাস্যকর ও বেপরোয়া সরাসরি পরীক্ষণ! কিছু খোয়ার ইট হাতে নিয়ে, পরবর্তী সেনাবাহিনীর গাড়ি যখন সামনে আসলো, তখনই আমরা তিনজন ঢিল ছুঁড়ে মারলাম সোজা সেনাদের মাথার দিকে! 
ঢিল ছুঁড়েই দিলাম ভোঁ দৌড়। আজও বিস্ময় জাগে, কত বড় দুঃসাহস আমাদের কচি মনে বাস করতো।

২. একবার ডাউয়া ফল খেলাম।কোন চঞ্চল সৃজনশীলতা মাথায় ঢুকে বসেছিলো, আমি ভাবলাম এই ফলের বিচিটা যদি নাকের ছিদ্র দিয়ে ঢোকাই, কেমন হয়!ভাবনা যেই, কাজ সেই। বিচিটি নাকের এক পাশ দিয়ে সযত্নে ঢুকিয়ে ফেললাম। প্রথমে কিছুই মনে হলো না। কিন্তু বের করার সময় বুঝলাম বিচি তো বের হয় না! যতই চেষ্ট করি, যতই চাপ দিই, বিচি যেন নাকের গহ্বরে গভীরে সরে গিয়েছে। ঘরে হুলস্থুল পড়ে গেল। আব্বু, আম্মু, প্রতিবেশী সবাই ছুটে এলেন।ফলের বিচি নাকের মধ্যে ঢুকাইলাম,কিন্তু বিচি তো আর বের হয় না।পরলাম মহা বিপদে।আব্বু-আম্মু পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই চেষ্টা করেও বিচি বের হয় না।এদিকে আমিও কান্না আর ভয় নিয়ে ভাবতেছি নাকের যেই ছিদ্র দিয়ে বিচি ঢুকলো সেই ফাঁক দিয়ে বিচি বের হওয়ার কথা,কিন্তু বিচি বের হচ্ছে না কেনো?ঠিক যেনো "সবার অংক মেলে কিন্তু আমার অংক মেলে না।কি জটিল ঝামেলা!এ যেন নাক আর বিচির লড়াই। নানা চেষ্টায় ব্যর্থ হলে অবশেষে আমাকে স্থানীয় মেডিক্যাল নিয়ে যায়। ডাক্তার বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে সেই বিচিটি বের করলো। সেই মুহূর্তে আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যার সমাধান পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।


স্কুলের স্মৃতি 

বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিলো ৫ কি.মি.।আমরা বৌদ্ধ আঙ্কেলের স্কুল ভ্যানে যাতায়াত করতাম।যে ভ্যানটা পুরা এলাকাজুড়ে মুরগীর হোরপা নামে পরিচিত ছিলো।আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। প্রতিদিন সকালে সেই পথ পাড়ি দিতাম বৌদ্ধ আঙ্কেলের বিখ্যাত স্কুল ভ্যানে ।ভ্যানটা আমাদের পুরো এলাকায়  “মুরগীর হোরপা” নামে পরিচিত ছিল। রাস্তার ধারে শিশু থেকে মহিলা সবাই আমাদের ভ্যান দেখেই চিল্লাফাল্লা করে উঠত, “মুরগীর হোরপা বলে!কখনো কখনো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত। তখন ভ্যান লাফ মেরে গ্রাম্য কিছু পিচ্চিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে “প্রশিক্ষণমূলক চপানি দিতাম।কখনোবা একযোগে সবাই মিলে উদুম কেলানি দিতাম।

টিফিন পিরিয়ডে পালানোর ঘটনা:

সে সময় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি।টিফিন পিরিয়ডের পর ছিলো ইসলাম শিক্ষা ক্লাস।ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করলাম। ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে গিয়ে প্রাচীর টপকাবো। হুট করে এক লাফে দেয়াল টপকে নামতেও পারলাম, কিন্তু ঘটলো বিপত্তি। পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলো। মুচির দোকানে গিয়ে সেলাই করাতে হলো। সেই সেলাইয়ে সময় গেলো, আর টিফিনের টাকাও গেলো।  পরে মনে হলো এটা সম্ভবত ধর্ম ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার শাস্তি।

সেই “মুরগীর হোরপা”, সেই দেয়াল টপকে পালানো কিংবা ছেঁড়া স্যান্ডেল, সব মিলিয়ে স্কুলজীবন যেন এক চিরন্তন গল্প, যা বারবার মনে পড়ে, প্রতিবার নতুন করে হাসায়। অতীতের সেই দুষ্টুমিগুলো আজ আর নেই,  স্মৃতিগুলো আজীবন হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। এই স্মৃতিই তো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ।

আমার শৈশব গ্রামে কেটেছে, তাই  স্মৃতিগুলো যেন আরও বেশি প্রাণবন্ত। সকালের শিশিরভেজা ঘাসে হাঁটার আনন্দ , পাখির ডাক শোনা, গাছের ডালে দোল খাওয়া, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া।এসব দৃশ্য আজকের শহুরে বাচ্চারা কল্পনাও করতে পারে না।

আঁখি

×