ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজচেতনা

গাউসুর রহমান

প্রকাশিত: ১৭:৪২, ২৬ জুন ২০২৫

কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজচেতনা

আব্দুল গনি হাজারী দেশপ্রেমের সূত্রধর। স্বদেশী চেতনা তাঁর কবিতার গতিভঙ্গিতে নতুন নতুন প্রবর্তনা পেয়ে যায়। স্বদেশ, স্বদেশের মুক্তিচৈতন্য, স্বদেশের মাটি ও মানুষ তাঁর কবিতার প্রকৃত উপাদান। পাশাপাশি আত্মউন্মোচন, মনোবিকলন, অস্তিত্বের সংকট, বিবমিষা, জীবনের শতমুখী জটিলতা, সময়ের পীড়ন, সমাজচেতনার সুস্থ গতি সর্বোপরি সামগ্রিক জীবনের প্রেক্ষাপট আব্দুল গনি হাজারীর কবিতায় শিল্পের সমর্থন নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। 
মৃত্তিকা ও মানুষের সমবেত পদবিক্ষেপের সঙ্গে অবলীলায় সংযোগ স্থাপন করেছেন আব্দুুল গনি হাজারী। স্বদেশের প্রতি ভাবার্পনের মাধ্যমে তিনি তাঁর নন্দনচিন্তাকে পূর্ণায়ত করেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সামান্য ধন (১৯৫৯), ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’, ‘সূর্যের সিঁড়ি’ (১৯৬৫), ‘জাগ্রত প্রদীপ’ (১৯৭০)। অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘স্বর্ণগর্দভ’ (১৯৬৪), ‘ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষা’ (১৯৭৫)। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রম্যরচনা ‘কালপেঁচার ডায়েরি’।

কবিতায় অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে আব্দুল গনি হাজারী বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৪ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পেশায় সাংবাদিক আব্দুল গনি হাজারী সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে মরনোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। 

আব্দুল গনি হাজারী ১৯২১ সালের ১২ জানুয়ারি পাবনার সুজানগরে জন্মগ্রহণ করেন। তখন সুজানগর ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত। ১৯৭৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্তিম চেতনাকে কবিতায় ধারণ করেছেন আব্দুল গনি হাজারী। মুক্তিযুদ্ধের অনিরুদ্ধ আবেগ, মুক্তিচৈতন্য, সংগ্রাম-সংক্ষোভ তাঁর কবিতার সঙ্গে সমান্তরাল। হাজারীর কবিতা সময়, সমাজের আকাশে হৃদয়-নগরের তারা। নিখিল হৃদয়ের দলছুট যাত্রা না হয়ে তাঁর কবিতা পলল রোমান্টিকতার তবকে মোড়া বিবেকের এক একটি এটম :

‘জুলেখা তুমি ডেকো না
কিংখারের পর্দার কিনার ছেড়ে দাও
অন্ধকারকে প্রবেশ করতে দাও ঘরে
হে জুলেখা
প্রেমহীন মন্দিরের নিঃসঙ্গ সেবাদাসী
ব্যস্ততার কোরবানিকে
উৎসর্গ করো নামহীন মানুষের জন্য।’
[জুলেখার প্রতি জাগ্রত প্রদীপ]

কাব্যরচনার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছেন আব্দুল গনি হাজারী। কবিতার গতি ও যতির ডায়ালেকটিক্সে প্রারম্ভিক যতির ব্যবহার বা স্থানিক আধিপত্যের সৃষ্টি করে কাজের আঙ্গিক কুশলতায় যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা ও আয়তন। যতি ব্যবহারে হাজারীর অসামান্য কৌশল ‘দেরদীয়’  ‘ফরভভবৎবহপব’-এরই অনুগামী। শুধু তাই নয়, তাঁর কবিতায় গতি ও যতির সহাবস্থানও সহজলভ্য। ভাষিক ও বাগর্থিক আচরণের শুদ্ধতায় ফুটে উঠেছে হাজারীর নিরীক্ষাপ্রবণ মনোভাব। বৈপরীত্যের দ্বিধা-সঙ্কোচ আব্দুুল গনি হাজারীর কবিতা ভাষিক ও মানবিক টানাপোড়েনের চোরাবালিতে আটকে যায়নি। কবি লেখেন-

‘তোমাদের পিতাকে ছড়িয়ে দিলাম’
সংশয়ের দ্রুত তরঙ্গে
প্রত্যয়ের অস্থিতে
বন্ধ্যা রাত্রি উন্মুখ গর্ভে
সূর্যের স্বপ্নে
মধ্যরাত্রির জাগ্রত প্রদীপে।’
[ জাগ্রত প্রদীপে, ‘জাগ্রত প্রদীপে’ ]
কেবল কুহক আত্ময়তা নয়, আব্দুুল গনি হাজারীর কবিতায় আছে তত্ত্বের বিন্যাস এবং সেই বিন্যাসের পরিপার্শ্ব। আরেক আছে- অনন্য ভাষাশৈলী, যার আছে সংকেত ও চিহ্ন অভিজ্ঞান এবং উদ্ভাসের সুনির্দিষ্ট ঐতিহ্য। তিনি মনে করতেন- দার্শনিক অন্বেষা ও ভাষা বিশ্লেষণের সমস্ত ধারণা এবং প্রত্যয়ই খুলে দেবে শিল্পের মায়াবী জানালা। হাজারীর কবিতার ‘এফিগ্রাফ’ কবি ও কবিতার মধ্যে কোনো দূরত্ব নির্দেশ করে না। কবি লেখেন :

‘হায়! আমাদের ক্ষুধার ওয়েসিস
আশা বালিয়াড়ির মরীচিকা
সাদা মরোয়ার ব্যবধানে
বুক মাতৃত্বের উৎকণ্ঠা
বিদ্ধ বাতাসে উৎক্ষিপ্ত কেশ
উদ্বেল অঞ্চল
অনুর্বর প্রান্তরে আহত
পায়ে মাংসপেশী।’
[‘জননীয় তৃষ্ণার পথ, জাগ্রত প্রদীপে’]
ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের যৌথ অভিজ্ঞতার যুগ্মায়ন আব্দুল গনি হাজারীর কবিতা। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার অবদমিত আকাক্সক্ষা থেকেই কবিতা লিখেছেন আব্দুল গনি হাজারী। তাঁর ব্যক্তি- অনুভূতি ও সংবেদনা শক্ত গেরোয় বেঁধে রাখে তাঁকে। আর তাই তাঁর লালিত স্বপ্ন, অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা কবিতার ওপর দাঁড়াতে চেয়েছে। সমাজ উপযোগী তৎপরতায় কবির ব্যক্তিমানস গড়ে ওঠে বলেই তাঁর কবিতা নির্মিতি পায় ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তি কাঠামো এবং উপরি কাঠামোর নির্দেশ পালন করে। তাঁর কবিতায় নিরীক্ষার লীলাচাঞ্চল্য আছে, নব্যশৈলীবাদের ‘ঋৎবব ষবীরপধষ’ আছে। কবি লেখেন-


‘হে প্রকৃতির কন্যা
হে শক্তি ধৈর্য
যুগ-যুগান্তরের মুকুল দিলাম
তোমার তিতিক্ষার হাতে
তুমি তার মালিনী নও।
তুমি তার স্রষ্টা নও।’
[যুগ-যুগান্তরের মুকুল, জ্ঞানের প্রদীপে]

সমাজসমীক্ষা- আব্দুল গনি হাজারীর কবিতায় এসেছে রক্ত-মাংস-অস্থি-মজ্জাসহ রক্তাক্ত নগ্নতায়। সমাজের কবিতায় বেশি সুবিধাভোগী মানুষের ভোগ, তৃষ্ণা, ঐশ্বর্য, বিলাস-বৈভব তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। তিনি তাঁর কবিতায় লেখেন-

‘আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
তোমার দিকে মুখ ফেরালাম
হে প্রভু আমাদের ত্রাণ করো
বিশ্রামে বিধ্বস্ত আমরা
কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু আমাদের স্বামীরা
অগাধ নথিপত্রে ডুবুরি
(কি তোলে তা তারাই জানে)
পরিবার-পরিকল্পনায় আমরা নিঃস্ব
সময় আমাদের পিষ্ট করে যায়
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
সকাল থেকে সন্ধ্যা
কোন মহৎ চিন্তার কিনারে
এবং ফ্যাশন পত্রিকার বিবর্ণ পাতা
দৈনিক কাগজ সিনেমার ইস্তেহার
স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের উলঙ্গ ছবি
এবং একটি প্রাপ্ত-প্রায় মহত্বের শিহরণ।’
[‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’, ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী]

আব্দুল গনি হাজারীর কবিতায় আমাদের জনগোষ্ঠীর মানস-প্রতিবেশ, প্রেম-দ্রোহ, প্রাকৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈরিতা বিশেষভাবে ভাষা পেয়েছে। তাঁর জীবনান্বেষণ তাঁর কাব্যদর্শনের সমগোত্রীয়। তিনি সমকালের খোলকরতালের সঙ্গে মহাকাশের ও মহাজীবনের দুন্দুভি মিলিয়েছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় বস্তু ও ঘটনার সন্নিবেশ ঘটেছে বাস্তবনিষিক্ত হতে গিয়ে। কবি লেখেন-

‘যে ধ্বনির কোন শেকড় নেই
সে ধ্বনির মা নেই
সে পদশব্দের পদাঙ্ক নেই
ধূসর বালকের নদীর বালুবেলায়
সে শব্দের পায়ের অদৃশ্য দাগকে
অনুধাবন করে বৃথাই।’
[‘অন্নপূর্ণার দেশ’, ‘অন্নপূর্ণার দেশ’]

সূক্ষ্মদর্শী, তুখোড় জীবন প্রত্যয়ী আব্দুল গনি হাজারী ওজস্বিতা নিয়ে একনিষ্ঠ থেকেছেন জীবনের প্রতি, শিল্পের প্রতি, কবিতার প্রতি। পরিচ্ছন্ন জীবন আবেগে জীবনের বিভাজন মেনে নিয়ে শিল্পের গোড়া পত্তন করেছেন তিনি নান্দনিক উত্তরণের প্রশ্নে। সমকালীনতার কাব্যবিবরণী দিতে গিয়েও আব্দুল গনি হাজারী তাঁর কবিতার নাভিকেন্দ্রে স্বপ্নের ও কল্পনার চক্রমন ঘটিয়েছেন। 

প্যানেল

×