ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

চিঠির আপন ভুবন

প্রদীপ দত্ত

প্রকাশিত: ১৬:১০, ২৬ জুন ২০২৫

চিঠির আপন ভুবন

‘কিছুই লেখার নেই,/ তবু লিখো একটি পাখির শিস/ একটি ফুলের ছোট নাম।/ টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে -
কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে, সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প।/ খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে,/ তাই লিখো’।- (‘চিঠি দিও’ -মহাদেব সাহা)
প্রিয়তম মানুষের কাছে ‘একটু সামান্য দাবি ’একটি মাত্র চিঠি, তা সে চিঠি যদি ভুল বানানে হয় তাতেও চলবে। কবি লিখছেন ‘আঙ্গুলের মিহিন সেলাই তোমার শাড়ির মত অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।’ কবিতায় চিঠিকে এত মহিমময় করে তুলতে পারার কাজটি কেবলমাত্র একজন বাংলাদেশের কবির পক্ষেই সম্ভব। সেখানে রয়েছে তার আপন ভুবন।
 অমল ডাক হরকরা হতে চেয়েছিলো। রোগশয্যায় বদ্ধঘরের একটিমাত্র জানালায় বসে সে চেয়ে থাকতো বাইরের জগতের দিকে। রাজার প্রহরী তাকে বলেছিলো রাস্তার ওপারে বড় বাড়িতে সোনালী রঙের নিশান উড়িয়ে নতুন ডাকঘর বসেছে। রাজার ডাকঘর। অমল প্রতীক্ষায় ছিলো একদিন স্বয়ং রাজা তাকে চিঠি লিখবে। আর রাজার সেই চিঠি তার হাতে পৌঁছে দেবে ডাক হরকরা। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের অমল যেন সংস্কারবদ্ধ জীবনের ছবি। আর ডাকঘর সবাইকে সেই অচলায়তন ভেঙে মুক্ত জীবনের স্রোতে মিলিয়ে দেয়। একটা পুরানো চিঠি জীবনের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত করে। অতীত যেন এক লহমায় সামনে এসে দাঁড়ায়। হারিয়ে যাওয়া সেই সময় তার সোনালি ডানায় ভর করে উপস্থিত হয় বর্তমানের আঙিনায়। ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে’ চিঠির জুড়ি মেলা ভার। এই প্রজন্মের কাছে হয়তো চিঠির আবেদন আর তেমন একটা নেই। কিন্তু পঞ্চাশ কিংবা ষাট পেরোনো যে মানুষগুলো ঘোলা চোখে অন্তত একটি দিনেও কোনো গভীর একাকিত্বে যখন নিজের মধ্যে হারিয়ে যায়; তখন জীবনের একটি কিংবা কয়েকটি চিঠি কি তাকে স্মৃতিতাড়িত করে তোলে না? একটি চিঠির প্রতীক্ষায় বিনিদ্র রাত্রীযাপন যার জীবনে নেই তেমন মানুষ বিশ^-সংসারে খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুস্কর। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি নিজের ব্যক্তি জীবনকে ছাড়িয়ে কখনও কখনও সর্বজনীন সম্পদে পরিণত হয়। হয়ে যায় সাহিত্য কিংবা সময়ের পরিচায়ক। তাই দেখা গেছে নিতান্ত সাদামাটা কাগজে লেখা একটি চিঠি ইতিহাসকে অতিক্রম করে কালজয়ী সৃষ্টিকর্মে পরিণত হয়েছে। সাদা কাগজে কালো অক্ষরে হাতে লেখা চিঠির ঐশ^র্য এখানেই। মহাকালের ইতিহাসে এমনই এক একটি চিঠি ধারণ করে আছে প্রেম, দ্রোহ, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, বিপ্লব পিপাসা আর জীবনের বহুমাত্রিক স্বপ্ন। বাংলা সাহিত্য ও বিশ^ সাহিত্যের রত্নভাণ্ডারে মহাজনদের এমনই শত শত চিঠি আমাদের চিন্তার জগতকে যে কতভাবে প্রভাবিত করে আসছে যা কেবলই বিস্ময়ের। কারও জীবন আর কর্ম বিশ্লেষণে এই চিঠিগুলোর চেয়ে বড় প্রামাণ্য আর নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই। পূর্ববঙ্গের পৈতৃক জমিদারী রক্ষার কাজে শিলাইদহ শাহজাদপুর কিংবা পতিসরে এসে তিনি যে পূর্ণতা লাভ করেছিলেন তার অসংখ্য দিনের স্মৃতি তিনি লিখে জানিয়েছিলেন ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে। ‘ছিন্ন পত্রাবলী’ সংকলনের পাতায় পাতায় আমরা জেনেছি অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে। লিপিকা’র ‘প্রথম চিঠি’ নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আজ দেশ থেকে তার স্ত্রীর প্রথম চিঠি এল। লিখেছে ‘তুমি কবে ফিরে আসবে। এসো এসো, শীঘ্র এসো। তোমার দুটি পায়ে পড়ি।’ এই আসা যাওয়ার সংসারে তারও চলে যাওয়া আর তারও ফিরে আসার যে এত দাম ছিল, এ কথা কে জানত। সেই দুটি আতুর চোখের সামনে সে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখলে আর তার মন বিস্ময়ে ভরে উঠল।’ রবীন্দ্র মানসে চিঠি, ডাকপিওন, ডাকঘর তাঁকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে শাহজাদপুর গ্রামের একজন সাধারণ পোস্টমাস্টার রবীন্দ্র ভাবনায় একটি বিখ্যাত ছোটগল্পের নায়ক হয়ে উঠেন। আর সেই গল্পের প্রচ্ছন্ন রোমান্টিকতা আর দর্শন গল্পটিকে চির প্রাসঙ্গিক করে রাখে। শিলাইদহ পোস্ট অফিসের একজন ডাক হরকরা গগনচন্দ্র দাস, তার গাওয়া ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে-’ গানটির অনবদ্য সুর আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি-’ রূপে আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেয়। ফিরে আসি চিঠির কথায়। এক একটি চিঠির শুরুতে প্রাপককে সম্বোধন এর ভাষার কাব্যিকতা লক্ষণীয় যেমন প্রিয়বরেষু, প্রিয়তমাসু, প্রাণাধিকেষু, কল্যাণীয়া প্রভৃতি তেমনি চিঠি শেষ করার সময় লেখা হচ্ছে, ইতি তোমারই। ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নার্গিস আসার বেগম কে লেখা একটিমাত্র চিঠিতে কাজী নজরুল তাঁকে সম্বোধন করেছিলেন ‘কল্যাণীয়াসু’ বলে আর শেষ করেছিলেন ‘ইতি নিত্যশুভার্থী নজরুল’ বলে। এর আগে ১৯২৮ সালের ৮ মার্চ তারিখে কাজী মোতাহার হোসেন কে চিঠি দিয়েছিলেন কাজী নজরুল। বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে না পাওয়ার বেদনা থেকে লেখা এই চিঠিটি আমাদের পত্রসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কাজী নজরুল লিখছেন ‘যেদিন আমি ওই দূরের তারার দেশে চলে যাব, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দুফোঁটা অশ্রুর দর্পণ দেয় শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশিতে উল্কাফুল হয়ে তার নতুন খোঁপায় ঝরে পড়বো’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের দাবি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে। ব্রিটিশ রাজশক্তি বইটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। এই অবস্থায় শরৎচন্দ্র চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সেই সঙ্গে বইটির একটি কপি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিউত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘তোমার পথের দাবি পড়া শেষ করেছি বইটি উত্তেজক। অর্থাৎ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। লেখকের কর্তব্য হিসেবে সেটা দোষের না হতে পারে কারণ, 
লেখক যদি ইংরেজ রাজকে গ্রহণীয় মনে করেন, তাহলে চুপ করে থাকতে পারেন না। কিন্তু চুপ করে না থাকার যে বিপদ আছে সেটুকু স্বীকার করা চাই।’ বলা বাহুল্য যে শরৎচন্দ্র এই উত্তর পেয়ে খুশি হতে পারেননি। তিনি শক্ত করে একটা চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। যদিও সে চিঠিটি আর পোস্ট করা হয়নি।
 যখন ফোর্ট উইলিয়ামে অধ্যাপনা করছিলেন তখন একদিন মায়ের চিঠি পেয়েই এক ঝড়-জলের রাত্রিতে সাঁতরে দামোদর পাড়ি দিয়ে বীরসিংহা গ্রামে পৌঁছেছিলেন বিদ্যাসাগর ঈশ^রচন্দ্র। আবার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কলকাতার বাদুড়বাগানের বাসা ছেড়ে বর্তমান ঝাড়খন্ডের কারমাটারে সাঁওতালদের গ্রামে এসে একাকি বসবাস করতে শুরু করেন। তার আগে ১২৭৬ বঙ্গাব্দের অঘ্রান মাসে স্ত্রী দিনময়ী দেবীকে এক চিঠিতে লিখেন ‘আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে, আর আমার সে বিষয়ে অনুমাত্র স্পৃহা নাই। বিশেষতঃ ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা-। এক্ষণে তোমার নিকটে জন্মের মত বিদায় লইতেছি এবং বিনয়াবাক্যে প্রার্থনা করিতেছি যদি কখনও কোনও দোষ বা অসন্তোষের কার্য করিয়া থাকি, দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করিবে।’ 
শুধু সাহিত্য নয় চিঠি প্রভাবিত করেছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম-ইতিহাস, সমাজ-সংস্কার, বোধ-বিশ^াস সবকিছুকেই। স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কালিফোর্নিয়া থেকে তাঁর সতীর্থ স্বামী অখন্ডানন্দকে এক চিঠিতে লিখছেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের স্বার্থপরতা, নেহাত দুষ্টুমী করে হয়নি, বহু শতাব্দী যাবৎ বিফলতা আর নির্যাতনের ফলস্বরুপ এই পশুবৎ স্বার্থপরতা; ও আসলে স্বার্থপরতা নয়- ও হচ্ছে গভীর নৈরাশ্য’। তিনি আরও লিখছেন ‘এই ঘোর দুর্ভিক্ষ,বন্যা, রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বল? খালি ‘আমাদের হাতে রাজ্য শাসনের ভার দাও’ বললে কি চলে? কে বা শুনছে ওদের কথা? চিঠিতে তিনি তাঁর গুরুভ্রাতাকে পরামর্শ দিচ্ছেন জেলায় জেলায় যুবকদের সংগঠিত করে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে দুর্গত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের আগের রাত্রিতে বীরকন্যা প্রীতিলতা তাঁর মায়ের উদ্দেশে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘মাগো তুমি আমায় ডাকছিলে, আমার যেন মনে হল তুমি আমার শিওরে বসে কেবলই আমার নাম ধরে ডাকছ আর তোমার অশ্রুজলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে। আমি স্বদেশ জননীর চোখের জল মোছাতে বুকের রক্ত দিতে এসেছি। দেশ যে পরাধীন, দেশবাসী যে বিদেশী অত্যাচারে জর্জরিত। তুমি কি নীরবে সব সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না। আমি যে সত্যের জন্য স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি।’ পন্ডিত নেহেরু ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন জেলে কারাবাস কালীন সময়ে মোট ১৯৬টি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর ১০ বছরের বালিকা কন্যা প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরাকে। সেই চিঠিগুলো একত্রে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দি গ্লিমসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ নামে। এই চিঠিগুলো কেবলই ব্যক্তিজীবনের চিঠি নয় এগুলোতে আছে ভারতবর্ষের ইতিহাস দর্শন অর্থনীতি সমাজবিকাশ থেকে তৎকালীন ও পূর্বাপর বিশ^রাজনীতির নানা উত্থান-পতনের ইতিহাস। প্রথম চিঠিতে নেহেরু লিখেছিলেন, ‘কয়েদখানার ভেতর থেকে তোমায় আমি যে উপহার পাঠাব তাকে বন্দী করে এমন সাধ্যি এই চারদিকের উঁচু প্রাচীরের নেই’। শেষ চিঠিতে লিখছেন ‘অতীত যা সে অতীতই, তার দিন ফুরিয়ে গেছে, তার আর পরিবর্তন আমরা ঘটাতে পারি না তবে ভবিষ্যত এখনও অনাগত, হয়তো তাকে ইচ্ছেমত গড়ে নিতেও আমরা খানিকটা পারতে পারি। অতীত ইতিহাস খানিকটা সত্যের সন্ধান আমাদের দিয়ে গেছে; সে সত্যের অনেকখানি আবার লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতেরই মধ্যে, তাকে খুঁজে বার করবার কর্তব্য আমাদেরই।’ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের এক গৌরবের সমাচার। সারা বাংলাদেশটাই তখন হয়ে উঠেছিল রণাঙ্গন। সেই রণাঙ্গন থেকে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা চিঠি লিখছেন তাদের আপন জনদের কাছে। 
এঁদের অনেকেই যুদ্ধশেষে আর ঘরে ফিরতে পারেননি। এমনই এক বীর শহীদ সাফি ইমাম রুমি এক চিঠিতে লিখছেন ‘আমরা একটা ন্যায়সংগত যুদ্ধ লড়ছি। আমরা জয়ী হব। আমাদের সবার জন্য দোয়া কোরো।—-নৃশংসতার যত কাহিনী তুমি শুনছ, ভয়াবহ ধ্বংসের যত ছবি তুমি দেখছ, জানবে তার সবই সত্য। ওরা আমাদের নৃশংসতার সঙ্গে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, মানব ইতিহাসে যার তুলনা নেই।’ (একাত্তরের চিঠি-প্রথমা)। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লেখা এমনই হাজার হাজার চিঠি আজ শুধু লেখক আর তার পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো আমাদের আবেগ আর চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় এমনই বিপুল বীর্যের সম্পদ। 
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে অমিত শেষ চিঠি লিখছে লাবণ্যকে। আবার লাবণ্য অমিতকে লিখছে তাও শেষবারের মত। চিঠির ভাঁজে ভাঁজে কবিতা। শুরুতেই লিখেছিলাম চিঠির আবেদন কে মহিমময় করে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কবিদের জুড়ি নেই। ‘ধাবমান কাল’ হয়তো আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে ও যাবে; কিন্তু ক্রমে ধূসর হয়ে আসা চিঠিগুলোর কালো অক্ষর, অনাগত সময়েও দ্যুতি ছড়িয়ে যাবে আর শত অন্ধকারে আমাদের পথ হারাতে দেবে না।

প্যানেল

×