ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

মাদকাসক্তিতে বেহাল

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৮:৫৪, ২৬ জুন ২০২৫

মাদকাসক্তিতে বেহাল

২৬ জুন পালিত হলো আন্তর্জাতিক মাদক দিবস। শুধু এই অস্বাস্থ্যকর ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যটি সেবন নয়, তার চেয়ে বেশি বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় পাচারের অসহনীয় চক্রব্যুহ। মাদক সেবন কিংবা পাচার কোনোটাই সামাজিক বলয়ের জন্য একটি সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থা তৈরিতে চরম বিঘ্নতার বেষ্টনী। সশস্ত্র বাহিনী থেকে পুলিশ, সীমান্ত প্রহরী প্রত্যেকের কড়া ব্যবস্থাপনার মধ্যেও সক্রিয় থাকছে সেবক এবং পাচারকারীরা। অনৈতিকই শুধু নয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে নিজে যেমন আক্রান্ত হয় পাশাপাশি সমাজকেও কলুষিত করে ধূম্রজালে আটকে দেয়। যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত কিংবা সহনীয় অনুকূল পরিস্থিতি নয়। মাদকের চরম আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না অনেকেই। বয়সের তারতম্যেও কোনো বাধা-বিঘ্ন দৃশ্যমান নয়। নারী-পুরুষ তো বটেই উদীয়মান প্রজন্ম ছাড়া ও নিম্নবিত্তরা এই ক্ষতিকর বস্তুটির প্রতি আসক্তির জেরে পরিবার থেকে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গন কলুষিত, দূষিত হতে বিভিন্ন মাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার চিত্র মোটেও স্বস্তিদায়ক কিংবা আশান্বিত হওয়ার কোনো সুযোগই থাকছে না। কোমলমতি শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না এমন ক্ষতিকারক পণ্যটির আগ্রাসন থেকে। সত্যিই ভয়াবহ এক চরম দুর্বিপাক। মাদক শুধু সেবনই নয় বরং নেশাগ্রস্ত অবস্থায়। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়াও ভিন্নতর দুর্ভোগ, নেশা এমন প্রলোভিত বিষয় যা শরীর মনকে শুধু আচ্ছন্নই নয় বরং চারপাশের পরিবেশ পরিস্থিতিকেও যে মাত্রায় অসহনীয় করে তোলে তা যেন রুদ্ধতার আর এক বন্ধনজাল। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে কোনো কিছু ফিরে তাকাতেও অমানিশার অন্ধকার জগত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর হরেক সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে আসক্তির ভয়াবহতা ছাড়াও আরও সংশ্লিষ্ট দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে। যা এক অস্বাস্থ্যকর, দম আটকানো পরিবেশ তৈরিতে সংশ্লিষ্টতার জীবন মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। নিকটজনরাও পারিবারিক বলয়ে শান্তি আর আনন্দের বিপরীত প্রদাহের মুখোমুখি হয়। অনাসৃষ্টির এই বদ্ধ পরিবেশ নির্মল বাতাস যেন আর এক অধরা স্বপ্নবুনন। সব চেয়ে অবাক বিস্ময় নারীরাও এমন অস্বস্তিকর অবস্থার শিকার হতে খুব বেশি দূরে থাকছে না। পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হওয়া শুরু করে ব্যক্তিক কলহ বিবাদের ঝুঁকিপূর্ণ আঙিনায় কোমলমতি শিশুদেরও আক্রান্ত করতে পিছু হটে না। গোটা দেশে ৮৩ লাখ মানুষই নাকি ভয়ানক মাদকাসক্তিতে ভারাক্রান্ত। বিশিষ্টজনরা বলছেন, যা দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেশ কলুষিতই নয় বরং জাতির কর্মস্পৃহা কমানোরও ভিন্নমাত্রার দুর্যোগ। শুধু কি তাই? মাদকের  মতো এমন নিষিদ্ধ পণ্যটির ওপর  আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। বরং মাদকের একাধিপত্যে পরিবার থেকে সার্বিক সমাজের নির্মল বাতাস শুধু কলুষিত নয় হিংস্রতার আবর্তেও নিপতিত হতে এগিয়েই থাকছে।  মানবিক মূল্যবোধের শুভবৃদ্ধির চরম স্খলন বলছেন জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞজনেরা। যা ঠেকাতে আরও সময় অপচয় হলে সমাজের যে দুরবস্থা দৃশ্যমান হবে তাকে সামলানো কঠিনতর এক অব্যবস্থায় রূপ নেওয়া উদ্ভূত পরিস্থিতির চরম বিশৃঙ্খলা। বিজ্ঞজনদের আলাপ-আলোচনায় স্পষ্ট হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোরই চরম দুর্বলতার বহির্প্রকাশ। এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চ পালিত হলো ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’। দিবসটির প্রাতিপাদ্যে নানামাত্রিক অসহনীয় দুর্বিপাক সংকট, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতা ছাড়াও ব্যক্তিক মূল্যবোধের চরম অবনতির বিষয়টিও সামনে চলে আসে। সভা, সমিতি, সেমিনার ছাড়াও নিষিদ্ধ পণ্যটির ক্ষতিকারক অব্যবস্থাও জনসমক্ষে হাজির করা হয়। 
‘মানুষ কেন মাদকে আসক্ত হয়’ এমন প্রশ্নও সভা, সমিতি আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল। করণীয়  এবং সমাধানের উপায় বিভিন্ন সময় নির্দেশিত হলেও কাজের কাজ কিছু না হওয়াও পরিস্থিতির চরম বিপন্নতা। যা সামাজিক বলয়কে অস্থিরতার শেষ দুরবস্থায় নিপতিত করতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না। নেশার প্রতি আসক্তি মানুষকে তার স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনা থেকেও কেমন যেন দূরে ঠেলে দেয়। মানবিক সুস্থ চেতনা অপসৃত হয়। কোনো এক ঘোরের মধ্যে ব্যক্তিক থেকে পারিবারিক জীবনের স্বস্তিদায়ক পরিবেশ অবশিষ্ট না থাকাও আসক্তির নৃশংস আঁচড়। ইয়াবা, গাঁজা আর মদ্যপান মাদকাসক্তের নিয়ামক পণ্য। বিভিন্ন প্রতিবেদনে  আরও ভয়ঙ্কর চিত্র কিছু মানুষ নাকি মাদককেই ঘুমের ওষুুধ হিসেবে নিয়মিত সেবন করেন। দুশ্চিন্তার কারণ তো বটেই। ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপই ছিল সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদন। তাই গত ছয় বছরে মাদকাসক্তের সংখ্যা  বাড়ার বিষয়টি এখনো অজানা। কারণ জনসংখ্যা বাড়ার মাত্রায় মাদক সেবন সংখ্যা বৃদ্ধি অবিচ্ছিন্ন সুতায় গাঁথা। সেখানে প্রশ্ন উঠছে মাদকাসক্তি নিরাময়ও পুনর্বাসন কার্যক্রম কতখানি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে? নাকি আরও ভয়ংকর পরিস্থিতিকে আলিঙ্গন করছে বোঝা মুশকিল। তাই নতুন গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করাও সময়ের অপরিহার্যতা। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ২০২৫-এর প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনটি ‘ড্রাগ রিপোর্ট ২০২৪’ নামে জনসমক্ষে এসেছে। এতে ভালো কিছু নির্দেশিত হয়নি। বরং আশঙ্কাজনকভাবে উঠে এসেছে মাদক উৎপাদন না করেও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মাদকের ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। রিপোর্টে আর উল্লেখ থাকে চারপাশের বিভিন্ন দেশের সীমান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা দিয়ে মাদক ঢুকছে আমাদের এই অঞ্চলে। শুধু তাই নয়, সীমান্ত বরাবরের মতো অরক্ষিত অবস্থায় থাকলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অবলীলায় বিন্দুমাত্র বাধা বিঘ্ন ছাড়াই। যা সুনির্দিষ্ট কোনো এক পেশিশক্তির চক্রের আবর্তে সীমাহীন দুর্ভোগকে টেনে আনছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচার আমাদের জন্য যে সর্বনাশা রাস্তা উন্মক্ত করে রেখেছে সেখানেই রুদ্ধতার বেষ্টনী তৈরি করতে আরও সময়ক্ষেপণ করলে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে থামানো কঠিনতর এক দুঃসহ বাতাবরণে আটকে যাবে। আরও ভয়ংকরভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে ভারত থেকে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে সেই আশির দশকেই  ফেনসিডিল আসা শুরু হওয়া প্রতিনিয়তই বেড়ে যাবার দুর্দশা। তা ছাড়া এখন ফেনসিডিলের জায়গা দখল করেছে আধুনিক ইয়াবা। মিয়ানমার থেকেও প্রচুর ইয়াবা সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে বলে তথ্য সূত্রে জানা যায়। শুধু তাই নয় দেশে যেমন কোনোভাবেই দুর্নীতি, অনৈতিকতাকে ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের অবস্থাও একই রকম। সশস্ত্র বাহিনী থেকে সীমান্তরক্ষী  প্রহরীদের হাতে পাচার চক্র একেবারেই আটকা পড়ছে না এমনটা নয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা ধরা পড়লেও  রাঘব বোয়ালরা অধরাই থেকে যাচ্ছেন। ধরা পড়া আসামিরাও কোনো এক সময়ে আইনের ফাঁকফোকরে খালাসও পেয়ে যাচ্ছে যা আর এক আইনি কার্যক্রমের অবরুদ্ধতার বেষ্টনী। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিও বটে। তবে উদীয়মান প্রজন্মই নাকি সর্বনাশা এই মাদকাসক্তির বেষ্টনী থেকে কোনোভাবে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। সেখানেই নতুন করে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ থাকছে। তাই পরিবার থেকে গোটা সামাজিক বলয়ের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে গেলে দেশের আগামীর প্রজন্মকে নেশাগ্রস্ত থেকে সুস্থ জীবনের নিশানায় এগিয়ে নেওয়া নিতান্ত জরুরি। আর ছোট-বড় যেই অপরাধী ধরা পড়ুক না কেন আইনি কার্যক্রমে তার যথার্থ শাস্তি বিধানও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। এর ব্যত্যয় সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে উস্কে দেবে। মাদক কখনো ব্যক্তির সেবনেই আবদ্ধ থাকে না বরং পরিবার থেকে গোটা সামাজিক বলয়কে দূষিত করতে পিছপাও হয় না। একেবারেই ছোঁয়াছে রোগ-বালাইয়ের মতো। অনেক দুঃসময় পার করে নতুন বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ায় আর কোনো অরাজক-অসুস্থ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যাবে না। 

প্যানেল

×