
মারার চেয়ে মারতে পারি-এটির ক্ষমতা বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ইরানে আক্রমণ করে তাদের এই ক্ষমতার অপব্যবহার করল। মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ইরান ঠিক তাই করেছে। প্রথমে ইসরাইলের হামলা এবং সর্বশেষ তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর কাতার, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই জন্যই ইরান বা পারস্য ঐতিহাসিকভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা।
১৯৭৯ সালে ইমাম আয়াতুল্লাহ খামেনি নির্বাসনের শর্ত ভেঙে ফ্রান্স থেকে ইরানের উদ্দেশ্যে, চলছে বিমান। মাঝ আকাশে খামেনি জানতে পারলেন; রেজা পাহলভী শাহ-এর অনুগত বিমানবাহিনী তাঁকে বহন করা বিমানটি ইরানের আকাশসীমায় ঢুকলেই গুলি করে ভূপাতিত করবে। এ কথা শুনে বিমানের বিবিসির সিম্পসনসহ বিদেশি সাংবাদিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু খামেনি মুখে কোনো শঙ্কা বা ভয়ের ছাপ নেই; আছে শুধু ইসলামের বিজয় পতাকা উড়ানোর তীব্র আকাক্সক্ষা। বিমানটিতে খামেনির বিপ্লবী যেসব সঙ্গী ছিলেন, তারা হাততালি দিতে শুরু করেন। কেউ কেউ আবেগে কাঁদতে শুরু করে দেন। তাদের বক্তব্য ছিল-তারা শহীদ হওয়ার মহান সুযোগ লাভ করতে যাচ্ছে। এমন সময় খামেনি বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। একজন সাংবাদিক খামেনিকে প্রশ্ন করল- ’এতদিন নির্বাসনে ছিলেন। আজ দেশে ফিরছেন। কেমন লাগছে আপনার?’ খামেনি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন- ’কিছুই মনে হচ্ছে না।’ পরে বিমানটিকে আর গুলি করা হয়নি। বিমানটি বেশ কিছুক্ষণ ধরে তেহরানের আকাশে চক্কর দিয়ে তেহরান বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আয়াতুল্লাহ খামেনিকে অভিবাদন জানাতে বিমানবন্দরে লাখ লাখ লোক সমাগম হয়। ধারণা করা হয়-পৃথিবীতে এতো বড় গণজমায়েত আর কোথাও হয়নি।
তারপরের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় অমর। ইরানের শেষ রাজা পাহলভী ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খামেনি ও বিপ্লবী দেশবাসীর কাছে পরাজিত হয়ে মিসরে পলায়ন করেন। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রের পতন হয়ে ইরানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানে ইসলামিক রেভুলুশনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাশক্তি অর্থনৈতিক, সামরিকসহ নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে এবং প্রতিনিয়ত আক্রমণ করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে কোণঠাসা করে রেখেছিল। অবশেষে ইসরাইল সরাসরি ইরানে আক্রমণ করে তাদের সামরিক বাহিনী প্রধানসহ বেশ কয়েকজন বাহিনী ও সংস্থা প্রধানকে হত্যা করে। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল-তাদের দেশের ক্ষমতাকাঠামো তথা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রপন্থি কাউকে বসিয়ে দেওয়া। ইসরাইলের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং ইরানের দেশীয় কিছু গাদ্দারের কারণে সংগঠিত এই হামলায় অনেকে ইরানের প্রাথমিক পরাজয় দেখে ফেলেছিল। কিন্তু বর্তমান ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনি এবং তাদের নেতৃত্বের বলিষ্ঠতায় এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এবার ইসরাইল তিনবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধের মতো সফল হয়নি।
উল্লেখ্য, তিন তিনবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরব বিশ্ব পরাজিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে মোসাদ আরব দেশগুলোর বড় বড় জেনারেল এবং নেতাদের টাকা ও নারী দিয়ে কিনে নিয়েছিল। এবার ইসরাইল ইরানের জেনারেল বা নেতাদের কিনে নিতে পারেনি; তবে দুই হাজার কিলোমিটার থেকে তাদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিখুঁত নিশানায় বাসগৃহে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের কয়েকজনকে হত্যা করে। ইরান এর পাল্টা জবাব দিতে মুহুর্মুহু মিসাইল হামলায় ইসরাইলকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইরানের তিনটা পারমাণবিক কেন্দ্র ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে বি ২ বোমারু বিমান দিয়ে বোমা হামলা করে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি; বরং ইরান যুদ্ধের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলির একটা তত্ত্বে বলা আছে, আধিপত্যবাদ (ঐবমবসড়হু) বা চরম আধিপত্যবাদ (ঝঁঢ়বৎ-ঐবমবসড়হু) চাপিয়ে দেওয়া এবং কোনো দেশে আক্রমণ করে দখল করার ক্ষেত্রে ৪টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ-ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও স্বদেশপ্রেম। এই চারটি যদি একটা দেশের অটুট থাকে তবে সেই দেশে পরাশক্তির আক্রমণ বা হ্যাজিমনি প্রয়োগ করা দুরূহ বা প্রায় অসম্ভব। ইরানের এই চারটি উপাদান বহালতবিয়তে আছে। রোমান, গ্রিক (আলেকজান্ডার), মঙ্গলরা (হালা খান/চেঙ্গিস খান), আরবরা পারস্য আক্রমণ করেছে কিন্তু একমাত্র আরবরা ছাড়া কেউ তেমন সফল হয়নি।
আরবরা ইরানে ইসলাম উপহার দিতে পেরেছে কিন্তু তাদের ভাষা-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে পারেনি। এ জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র অনারব দেশ ইরান যাদের ভাষা আরবি না হয়ে ফারসি, সংস্কৃতি তাদের নিজস্ব। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইল পরাজিত শক্তির নামান্তর।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি যেন ইরানের বিজয়গাথা রচিত হলো। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রকাশিত হয়েছে- ডোনাল্ড ট্র্রাম্প মিনতি করে ইরানের কাছে যুদ্ধবিরতি চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা যদি এমন নমনীয় হয় তবে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার ইসরাইলের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা সহজেই অনুমেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল অত্যন্ত কৌশলী দেশ। এই বিষয়ে ইরান এবং অন্য দেশগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। এখানে ইরান প্রমাণ করেছে, আরব বিশে^র অন্য দেশগুলোর মতো বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রো-ডলার খরচ করে ইউরোপ-আমেরিকার কাছ থেকে সহানুভূতি কিনে নয়; বুক উঁচু করে সাহসের সঙ্গে বাঁচতে হয়। ইসরাইলের বিষদাঁত ভেঙে সেটা তারা প্রমাণ করেছে। আমরা শুনে বড় হয়েছি, পার্সিয়ানরা মুসলমান না। তারা ইসলাম মানে না, তারা নাকি শিয়া। কিন্তু সারা দুনিয়ায় যখন সুন্নিরা নিপীড়িত-নির্যাতিত হয় তখন এই ইরানিরাই মজলুমদের পাশে দাঁড়ায় আর আমাদের প্রিয় সুন্নির বেশধারী পশ্চিমাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকে।
যা হোক, যুক্তরাষ্ট্র-কাতারে মধ্যস্থতায় ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি ৪টি বিষয় স্পষ্ট করল, ১. যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই সবকিছু করতে পারে না; কারণ চিন-রাশিয়া আছে; ২. ইসরায়েল ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে; তাদেরকে যেকোনো সময় ইরান ও অন্যান্য শত্রুপক্ষ হামলা সুযোগ তৈরি হয়েছে, ৩. বেনজামিন নেতানিয়াহুর পতন হবে এবং ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামবে। ভবিষ্যতে ইসরাইলকে নতজানু হয়েই টিকে থাকতে হবে; ৪. ইরান মুসলিম বিশ্বের শৌর্য-বীর্যের প্রতিক হয়ে উঠবে। তবে ইরানকে মোসাদ, সিআইএ, এফবিআই থেকে সাবধান থাকতে হবে। তারা যদি কূটকৌশল করে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনিকে যদি হত্যা করতে পারে; তবে যুদ্ধের মাঠে নতুন সমীকরণ আবির্ভূত হবে। অবশ্য ইরান যদি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়ে সফল হয় তবে তাদের সুপারপাওয়ার হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারলে তাদের সামরিক খাতে তেমন কোনো আধুনিক অস্ত্রের সংকট থাকবে না। ইতোমধ্যে তারা দেশি প্রযুক্তির মিসাইল, ড্রোন, বিমান, ভারী ও মাঝারি আকারের সকল যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। রাশিয়া ইরানের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে ইউক্রেন যুদ্ধে সফল হয়েছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থায় তাদের দুর্বলতা রয়েছে। তাদের মোসাদ বা এফবিআই-এর মতো আন্তর্জাতিক মানের গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে হবে। পরাশক্তি হিসেবে টিকে থাকতে গোয়েন্দা সংস্থা খুব প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
লেখক : শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
প্যানেল