
ইদানীং সামাজিক মাধ্যমে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ বিষয় তুলে ধরার চেয়ে বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের কায়েমী স্বার্থবাদী ও মতলববাজি মানুষ কর্তৃক প্রনীত প্রতিনিয়ত বানোয়াট, মিথ্যা এবং অমূলক বিষয়দি সম্বলিত অপপ্রচার তথা প্রোপাগাণ্ডার সাইক্লোন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, টিকটিক, স্নাপচ্যাট, লিঙ্কডইন ইত্যাদি ভর করে শত মাইল বেগে ছুটে চলেছে। এই সাইক্লোন কোনো বিধি নিষেধ মেনে চলে না। অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ইচ্ছে মতো তার মতো করে এ বিশে^র ছোট বড় ১৯৩টি দেশের প্রায় ৮ শত কোটির জনপদে বয়ে চলেছে। এতে বাংলাদেশ সরকারসহ দেশের ভাবমূর্তি ও ইমেজ বিপন্ন হচ্ছে। এরা এতটাই হিংস্র ও প্রতিহিংসা পরায়ন যে, কোনো কথা বলতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না।
বস্তুত প্রোপাগাণ্ডা হলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা বা অপপ্রচার যা ইংরেজি প্রতিশব্দ চৎড়ঢ়ধমধহফধ হিসেবে বহুল প্রচারিত এবং জনগণ এই শব্দেই অধিক পরিচিত। উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা অথবা প্রোপাগাণ্ডা হলো এমন ধরনের পক্ষপাতমূলক ও ভ্রান্ত তথ্য, যা একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্যের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সাধারণত আংশিক সত্য বা আংশিক মিথ্যাকে বা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যকে প্রচার করে। প্রকাশ থাকে যে ইংরেজি প্রোপাগাণ্ডা শব্দটি একটি আধুনিক লাতিন শব্দ, যা প্রোপাগারে ক্রিয়াটির একটি বিশেষ্য আকার। এর অর্থ হলো ছড়িয়ে যাওয়া। তাই ‘প্রোপাগাণ্ডা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো, যা ছড়িয়ে যায়। উৎপত্তিগতভাবে এই শব্দটির উদ্ভব হয়েছিল ১৬২২ সালে একটি ক্যাথলিক গির্জার তৈরি নতুন প্রশাসনিক একটি সংগঠন থেকে, যার নাম ছিল কংগ্রেগেশিও ডে প্রোপাগাণ্ডা ফিদে (Congregatio de Propaganda Fide)। বস্তুত এটি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ সংগঠন। অবশ্য এটি অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রোপাগাণ্ডা’ হিসেবে অভিহিত ছিল। আসলে প্রতিষ্ঠানটির কাজ ছিল অ-ক্যাথলিক দেশসমূহে ক্যাথলিক বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেয়া। আর ১৭৯০ এর দশক থেকে এই শব্দটি ধর্মনিরপেক্ষ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। কিন্তু ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই শব্দটি একটি নেতিবাচক অর্থ ধারণ করে, যখন শব্দটিকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যবহার করা শুরু হয়। তখন থেকে প্রোপাগাণ্ডাকে প্রায়ই কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, অবস্থান অথবা রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে জনগণকে প্রভাবিত পূর্বক মনোভাব বদলে দেয়ার মনোবিজ্ঞানগত কৌশলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, যার ফলে উক্ত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের প্রতি জনসমর্থন তৈরির পথ সুগম হয়। প্রোপাগাণ্ডা হচ্ছে এমন তথ্য, যা বস্তুনিষ্ঠ হয় না এবং প্রাথমিকভাবে কোনো শ্রোতাকে প্রভাবিত করতেই ব্যবহার হয়। মূলত বিংশ শতকে, ‘প্রোপাগাণ্ডা’ শব্দটিকে প্ররোচক অর্থে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ ঐতিহাসিকভাবে ‘প্রোপাগাণ্ডা’ শব্দটি একটি নিরপেক্ষ শব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল, যা পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি। সাধারণত প্রোপাগাণ্ডা- বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য বিভিন্ন ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। আর কালের পরিক্রমায় মাধ্যমের ধরন নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে। তাই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকর্ম, কার্টুন, পোস্টার, পুস্তিকা, চলচ্চিত্র, রেডিও সম্প্রচার, টিভি সম্প্রচার, ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইটকে (মোবাইল) উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, ইন্টারনেটের সুবাদে বার্তা এখন জনসাধারণের কাছে পৌঁছিতে আরও গতিশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য যে, মার্কেটিং মিক্সের আওতায় প্রসার (Promotion) বলে একটি কথা আছে। এক্ষেত্রে প্রচারই প্রসার। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রচার করতে গেলেও, নেতিকতা ও মানসম্পন্ন বিধি অতিক্রম করা যাবে না অর্থাৎ কোনো অবস্থায় পণ্য বা সেবার ব্যাপারে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না। এদিকে সাধারণ প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার মৌলিক পার্থক্য হলো, এটি নিরপেক্ষ তথ্য প্রকাশ না করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণকে একটি নির্ধারিত দিকে ধাবিত করতে সহায়তা করে। বস্তুত উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণায় এমন কিছু নির্বাচিত ঘটনা বা তথ্য সুচতুরভাবে তুলে ধরা হয়, যাতে কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে দর্শক শ্রোতা উপসংহার ভিত্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়। এসব তথ্য বা ঘটনা জনমনে আবেগের সঞ্চার করে এবং সংগতকারণেই যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তাভাবনা করতে বাধা দেয়। আধুনিক বিশ্বে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আদর্শগত বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের একটি বড় হাতিয়ার এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। আসলে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান অতীতে ও বর্তমানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে জনগণের মন-মানসিকতা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যে, তা এখন আরও চরম নেতিবাচক বিষয় হিসেবে বিবেচিত। এক্ষেত্রে হলোকস্টকে বৈধতাদানের জন্য নাৎসিদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা বড় একটি উদাহরণ। প্রকৃত অর্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের রীতিনীতি মেনে চলার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা। কিছুদিন আগেও স্বাস্থ্যসচেতনতা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অপরাধ সংঘটনের পর জনগণের করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখন নেতিবাচক দিকটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা বললে হয়তো একটুকু ভুল হবে না।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, প্রাচীন ইতিহাসের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় শেষ রোমান গৃহযুদ্ধগুলোতে, যেখানে অক্টাভিয়ান এবং মার্ক এন্টনি উভয়ই একে অপরকে তাদের পিতৃপরিচয়ের অভাব, পাশবিকতা, কাপুরুষতা, সাহিত্য ও বাগ্মীতায় অনুপযুক্ততা, লাম্পট্য, বিলাসিতা, মাতলামি এবং অন্যান্য খারাপ বিষয় নিয়ে দোষারোপ করেছিলেন। এদিকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে ছাপাখানার আবিষ্কারের ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা খুব সহজেই ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রে বিপ্লবের সময়, এর উপনিবেশগুলোতে সংবাদপত্র ও ছাপাখানার একটি উন্নত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। এরা পেট্রিয়টদের (যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার পক্ষে যারা) পক্ষে বেশি কাজ করত এবং লয়ালিস্টদের (ব্রিটিশদের পক্ষে যারা) পক্ষে কম কাজ করত। বর্তমানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বলতে যা বোঝানো হয়, সেই ধারণাটি তৈরি হয় ১৯ শতকে শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সমাজ গঠনের ফলে, যে সমাজ গণমাধ্যম কর্তৃক বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ হিসেবে পেতো। এ কারণে সরকার সেসময় থেকেই তাদের নিজেদের নীতিসমূহের পক্ষে জনসাধারণের মতামতকে প্রভাবিত করার প্রয়োজন বুঝতে শুরু করে। কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ফরাসী বিপ্লব এবং নেপোলিয়নিক যুগে প্রচুর পরিমাণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করা হতো। ১৯ শতকে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের এবলিশনিস্টগণ (যারা দাসপ্রথার বিলুপ্তি চাইতেন) দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জটিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা অভিযান শুরু করেছিলেন। আর ২০ শতকের প্রথম দিকে, চলচ্চিত্রের আবিষ্কারের ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রস্তুতকারকগণ রাজনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য একটি বিশাল সুযোগ লাভ করেন। এর মাধ্যমে জনসাধারণের একটি বিশাল অংশকে কোন বিষয়ে রাজি করানো অথবা কোন বাস্তব বা কাল্পনিক সত্তাকে শত্রুতে পরিণত করা অথবা কাউকে শত্রুর স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার একটি সুযোগ তৈরি হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চলচ্চিত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে রাশিয়ান ফিল ইন্ডাস্ট্রিকে স্পনসর করেছিলেন। সত্য কথা বলতে কি, ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশককে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার স্বর্ণযুগ’ বলা হয়, যে সময়ে টোটালিটেরিয়ান বা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। নাৎসী জার্মানিতে কার্যরত চলচ্চিত্র-প্রস্তুতকারক লেনি রিফেনস্টাল সবচেয়ে পরিচিত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি তৈরি করেন, যার নাম ছিল ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এনিমেশন শুরু হলে, তা দ্রুত বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই জনপ্রিয়তার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ দর্শকদের মন জয় করে ফেলে এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। বস্তুত উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণাকে প্রায়ই ধর্মীয় ব্যাপারগুলোতে মতামত ও বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করা হতো, বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের বিচ্ছিন্নর ক্ষেত্রে, যা ইতোপূর্বে কিছুটা আলোকপাত করেছি। উল্লেখ্য যে, সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার প্রয়োগ সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠে; বিশেষ করে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা প্রণোদিত নির্দিষ্ট কিছু প্রচেষ্টা ও গোপন স্বার্থের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে ২০ শতকের প্রথম দিকে, পার্টি স্লোগানের আকারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে তুলে ধরা হয়। এছাড়াও সেই সময়ে বর্ধিষ্ণু জনসংযোগ শিল্পগুলোতে (Public Relations Industry) প্রোপাগাণ্ডা শব্দটি খুব ব্যবহৃত হতে শুরু করে। অবশ্য এই ব্যবহারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে যুদ্ধের সময় প্রচারণা ছড়ানো একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা তৈরী করে তাদের অমানুষে রুপ দেওয়াই থাকে এই প্রচারণার উদ্দেশ্য। এই কাজ করার জন্য জাতিগত বিদ্বেষ এবং নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহার করে শত্রুদের খারাপ মানসিকতার অধিকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়।
সাধারণত বার্তার উৎস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ও প্রকৃতি অনুযায়ী তিন শ্রেণিতে বিভক্ত; যেমন (i) শ্বেত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা হোয়াইট প্রোপাগাণ্ডা আসে কোনো মুক্ত শনাক্তকৃত উৎস্য থেকে, আর এটি প্ররোচনা করার নম্র কৌশল হিসেবে পরিচিত, যেমন আদর্শ জনসংযোগ কৌশল এবং কোন বিষয়কে একপাক্ষিকভাবে দেখানো, ইত্যাদি। (ii) কৃষ্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা ব্ল্যাক প্রোপাগাণ্ডা হচ্ছে সেগুলো, যেগুলোতে মানুষ এক জায়গার; কিন্তু ঘটনা আরেক জায়াগার। এক্ষেত্রে প্রোপাগাণ্ডার আসল উৎস্যটিকে লুকিয়ে রাখা হয়, যাতে একে কোনো শত্রু রাষ্ট্রের বা নেতিবাচক পাবলিক ইমেজের ব্যক্তির সংগঠনের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়। (iii) আর ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা হচ্ছে এমন যেগুলোতে উৎস্য বা লেখককে শনাক্ত করা যায় না। ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার একটি প্রধান প্রয়োগ হচ্ছে স্ট্র ম্যান যুক্তির সাহায্যে শত্রুকে ভুল বিশ্বাস করানো। এক্ষেত্রে উদহারণ হিসেবে উল্লেখ্য যে কাউকে “ক” বিশ্বাস করাবার জন্য প্রথম ধাপে ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা “খ” প্রচার করা হয়, যা “ক” এর বিপরীত। দ্বিতীয় ধাপে “খ” কে কোনো স্ট্র ম্যান অখ্যাতি বা মর্যাদাহানি করা হয়। এরফলে শত্রুরা ধরে নেয় যে “ক” সত্য। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। যেমন, কোনো নির্দিষ্ট দল বা বাইরের কোনো দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য (Disinformation) ছড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় উৎসাহিত করা। উল্লেখ্য যে, ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটসের আর্টিকেল ২০ এ যুদ্ধের জন্য যে কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণায় সাধারণ বা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ এগুলোর দ্বারা অপরাধে উসকানি প্রদান, বৈষম্য, শত্রুতা এবং আইনের লঙ্ঘনের পর্যায়ভুক্ত। আর ব্যবসায়ীকভাবে উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা মূলত সংস্থাই চালায়। এর মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের (যেমন: তাদের দ্রব্যের গুণাগুণ, তাদের সেবার মান, তাদের এলাকা বা দেশভিত্তিক কার্যক্রমকে পজেটিভভাবে তুলে ধরতে) প্রচারণা চালায়। মজার ব্যাপার হলো যে কর্মক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা চালানো হয়, সেটা কর্মীর দ্বারা সরাসরি কর্মীদের উপরেই ব্যবহার করা হয়। আসলে উদ্দেশ্যমুলক বিকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সে সিদ্ধান্ত কে বৈধতা দান করতেই প্রচারণাকে ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য যে, সামাজিক মনোবিজ্ঞানগত গবেষণাগুলোর ভিত্তিতে অনেকগুলো কৌশলকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এই কৌশলগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে এমন যুক্তিবাক্য ব্যবহৃত হয়, যা কখনো কখনো বিশ্বাসযোগ্য হলেও সবসময়ই যে সঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই।
এতক্ষন প্রোপাগাণ্ডার তাত্ত্বিক দিক কিছুটা তুলে ধরলেও এবার আসুন এর ফলিত দিকে কীভাবে কাজ করে, তা তলিয়ে দেখা যাক। মজার বাপার হলো, যে দেশটি উদহারণ হিসেবে বিবেচনায় এনেছি সে দেশ আবার আমাদেরই বাংলাদেশ। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, বিগত ২০/০৬/২০২৫ তারিখে প্রকাশিত জনপ্রিয় পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিনে দেখলাম প্রোপাগাণ্ডার শিকার হচ্ছে অনেকে। এক্ষেত্রে বলতে দ্বিধা নেই যে, দেশে প্রোপাগাণ্ডার সুনামি শুরু হয়েছে। সবাই যেন সাংবাদিক বনে গেছেন। এক্ষেত্রে সৎ ও ভালো লোকের ইমেজের মৃত্যু হচ্ছে। বলতে গেলে সতী নারীকে অসতী করে তুলা হচ্ছে। দুঃখজনক হলে সত্য যে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলগতভাবে মোবাইলের মাধ্যমে যে যা ইচ্ছে করছে; তাই বলছে। শুধু এখানে নয় প্রতিবেশী দেশসহ বাইরের অনেক দেশ থেকে অহরহ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চ্যাটপিজিটির আদলে টিকটকের যেন ভরা মৌসুম। এখানেই শেষ নয়, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বসে নেই। তাঁরাও তাঁদের মতো করে ডায়ালগে আকর্ষণীয় শব্দ চয়ন করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রোপাগাণ্ডা করে চলেছে। আশ্চার্যের ব্যাপার হলো যে তাদের কথায় গঠনমূলক কিছু নেই। নেতিবাচক বিষয়াদি তুলে ধরে সমালোচনার জন্যই সমালোচনা করে চলেছেন। আর তাঁরা ইচ্ছে করেই এই মিথ্যা বানোয়াট তথ্যাদি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। মনে হয় এটি যেন তাঁদের নেশা, না করলে বোধ হয় ভাত হজম হবে না। অথচ এতে ব্যক্তি বিশেষ নয়; দেশের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং দেশের যে ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে; তা এতটুকু ভাবেন না। মজার ব্যাপার হলো যে, এই প্রোপাগাণ্ডা হলুদ সাংবাদিকতাও ছাড়িয়ে গিয়েছে। অথচ আমরা ভাবি না, তথ্য একটি সম্পদ; অথচ যে যার মতো করে এটি অপব্যবহার পূর্বক অপপ্রচার করে চলেছে। কেউ কাকেও ছাড় দেয় না, যেন মহাপণ্ডিত। সেহেতু সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। কোনটি সত্য, বা কোনটি মিথ্যা, তা বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রোপাগাণ্ডা বা অপপ্রচার কোনো নির্দিষ্ট আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত না হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫ এবং ৩১ ধারায় এর সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধের উল্লেখ আছে। আর ২৫ ধারায় বলা হয়েছে যে যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত আক্রমণাত্মক ভীতি প্রদর্শন বা মিথ্যা অপপ্রচার করে, যা কোন ব্যক্তির বিরক্ত, অপমান বা হেয় প্রতিপন্ন করা উদ্দেশ্য করা হয়, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
পরিশেষে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই মর্মে অনুরোধ করব যে তাঁরা যেন তাদের মননশীলতা ও মনোদৈহিক ক্ষমতা নেতিবাচক দিকে ব্যয় না করে ভালো ও গঠনমূলক কাজে ব্যয় করেন, এতে তাঁদের তো উপকার হবেই। তাছাড়া দেশের গণমানুষ দিশেহারা না হয়ে সঠিক পথে চলতে পারবে এবং একইসঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
লেখক : গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
[email protected]
প্যানেল