
সূত্রাপুরের মোহিনী মোহন দাস লেনে ঢাকা কেন্দ্রের প্রদর্শনী কক্ষে গ্রামোফোনসহ নানা নিদর্শন দেখছেন দর্শনার্থীরা
অতীত মানুষকে কাছে টানে। স্মরণ করিয়ে দেয় শিকড়ের কথা। সেই অতীতের সূত্র ধরেই সামনে আসে ইতিহাস। বায়ান্ন বাজার তিপান্ন গলির এই শহরের তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্র। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের মোহিনী মোহন দাস লেনে দেখা মিলবে এই প্রতিষ্ঠানটির। ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সযত্নে আগলে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে রয়েছে ঢাকার আদ্যোপান্ত মেলে ধরা বিশাল এক গ্রন্থভা-ার। শহর ঢাকার অলিগলির কথা থেকে উৎসব কিংবা বিস্তৃত ইতিহাস জানতে জুড়ি নেই এই পাঠাগারের। সেই সুবাদে ছাত্র-শিক্ষক থেকে ঢাকা বিষয়ক গবেষকদের প্রিয় প্রাঙ্গণে পরিণত হয়েছে ঢাকা কেন্দ্র। জ্ঞানার্জনের সমান্তরালে এখানে রয়েছে মন ভালো করার নানা অনুষঙ্গ। প্রদর্শনী কক্ষে মিলবে এই শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা প্রাচীন নিদর্শন। চোখে পড়বে আলোকচিত্রে সজ্জিত ঢাকার পঞ্চায়েত গ্যালারি। লতা-পাতা আর পুষ্পে শোভিত বাগানে বসে কাটিয়ে দেওয়া যায় সুন্দরতম সময়। এই বাগানের এক কোণে রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মঞ্চ। আছে সাহিত্যবিষয়ক আড্ডার টেবিল। সব মিলিয়ে বহুমুখী বিড়ম্বনার শহরেও একখ- স্বস্তির সুবাতাস মেলে এই আঙিনায়।
একটি দোতলা ভবনে গড়ে উঠেছে ঢাকা কেন্দ্র। নিচতলায় লোহার সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছুতে হয় কেন্দ্রে। সিঁড়ির পাশেই রয়েছে কবিতায় আবহমান বাংলার স্বরূপসন্ধানী কবি জসীম উদ্দীন স্মৃতি চত্বর। এছাড়া নিচতলা থেকে দোতলার চারপাশজুড়ে দৃশ্যমান হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি কায়কোবাদ, ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ বিশ্বখ্যাত ও বিখ্যাত বাঙালি ব্যক্তিত্বদের ছবি। ফ্রেমে বাঁধানো সেসব ছবি দেখতে দেখতে প্রবেশ করি দোতলার ঢাকা বিষয়ক দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে। সেথায় কথা হয় ঢাকা কেন্দ্রের সমন্বয়ক মোঃ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তার সঙ্গে
আলাপচারিতায় জানা যায়, ঢাকার নানা বিষয়নির্ভর ছয় হাজার বই রয়েছে এই পাঠাগারে। সেই সূত্রে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসুদের ভিড় জমে এই ভবনে। এখানে আসা বইপ্রেমীদের তালিকায় রয়েছে ছাত্র-শিক্ষক থেকে গবেষক। এমনকি রাজধানী নিয়ে কৌতূহলী ভিনদেশি পর্যটকরাও ঢুঁ দেন এই গ্রন্থরাজ্যে। বই পড়ার জন্য বিছিয়ে রাখা হয়েছে বিশাল আকৃতির টেবিল। একসঙ্গে কুড়িজন বসে গ্রন্থ পাঠ করতে পারেন এই টেবিলে। একাধিক বুকসেলফে সাজিয়ে রাখা হয়েছে গ্রন্থসমূহ। হাজার বইয়ের ভিড়ে মিশে রয়েছে গবেষকদের জন্য কাক্সিক্ষত বেশ কিছু দুর্লভ গ্রন্থ। তেমনই এক বই ১৯১৭ সালে প্রকাশিত প্যাট্রিস গেড্রেস রচিত ‘ঢাকা নগর উন্নয়ন প্রতিবেদন’। এর বাইরে রয়েছে আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’, ড. মো. আলী খানের ‘মধু দা’, আবু যোহা নূর আহমদের ‘উনিশ শতকের ঢাকার সমাজজীবন’, আশরাফ কায়সারের ‘ঢাকার আড্ডা ও অন্যান্য’, কেদারনাথ মজুমদারের ‘ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস’, নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, নির্মল গুপ্তের ‘ঢাকার কথা’, যতীন্দ্র মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’, রফিকুল ইসলামের ‘ঢাকার কথা’, সত্যেন সেনের ‘শহরের ইতিকথা’, হরিদাস বসুর ‘ঢাকার কথা’সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বইয়ের বাইরে রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ঢাকাবিষয়ক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদনে সাজানো ৬০টি পেপার ক্লিপিং ভলিউম। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের লেখা ঢাকাবিষয়ক বই নিয়ে গড়া হয়েছে একটি পৃথক কর্নার। সাধারণ পাঠকের জন্য লাইব্রেরিটি খোলা থাকে বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। গবেষকের জন্য উন্মুক্ত থাকে সকাল দশটা থেকে দুপুর দুইটা অবধি।
লাইব্রেরির মতোই ঢাকা কেন্দ্রের প্রদর্শনী কক্ষটিতেও নানা আকর্ষণীয় নিদর্শন। সেখানে চোখে পড়ে দর্শনার্থীকে স্মৃতিকাতর করে তোলা গ্রামোফোন রেকর্ড। শোকেসে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মুঘল ও ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমানকালের বিবর্তিত কয়েকটি ইট। আছে ঢাকার প্রথম ট্রাফিক সিগন্যাল সুইচ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিশালাকৃতির রেডিও, বাকরখানি রাখার টিনের বাক্স, সুদৃশ্য পিতলের প্রদীপদানি, ব্রিটিশ আমলের আনটানা বিলিয়ার্ড বলসহ নানা নিদর্শন। এর বাইরে আছে মাওলা বখশ সরদার পারিবারিক গ্যালারি ও পঞ্চায়েত গ্যালারি। আলোকচিত্রের সঙ্গে সরদার পরিবারের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী রয়েছে গ্যালারিতে। রকমারি ফুল, ক্যাকটাস ও উদ্ভিদে সুসজ্জিত বাগানে রয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উন্মোচিত মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবিময় বিজয় ভাস্কর্য।
প্যানেল