ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

৭০ অনুচ্ছেদ যে কারণে সংস্কার করা উচিত

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০১:৫৭, ২৭ জুন ২০২৫

৭০ অনুচ্ছেদ যে কারণে সংস্কার করা উচিত

গণতন্ত্রের মূল প্রাণশক্তি হল জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এই মৌলিক অধিকারকে সীমিত করে দিয়েছে, যা আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই দুর্বল করে ফেলেছে। ২০২৫ সালের ১৭ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় এই অনুচ্ছেদ সংস্কারের বিষয়ে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া গেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বর্তমান সময়ে যখন বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এই অনুচ্ছেদ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে গেছে। আসুন দেখি কেন এই সংস্কার আমাদের জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে নির্বাচিত সংসদ সদস্য যদি সেই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারাবেন"। এই বিধান সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, যা গণতন্ত্রের মূল নীতির পরিপন্থী। ২০২৫ সালের জুন মাসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনায় বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এই অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছে, যাতে সংসদ সদস্যরা অর্থবিল এবং অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কারণ এর ফলে সংসদে গঠনমূলক বিতর্ক ও আলোচনার পথ সুগম হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ৭০ অনুচ্ছেদ ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যোগ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর নবগঠিত বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। তৎকালীন সময়ে দলত্যাগ বা 'ফ্লোর ক্রসিং' এর মাধ্যমে সরকার পতনের আশঙ্কা ছিল, যা নতুন রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। কিন্তু পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর, এখন এই বিধান গণতন্ত্রের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, "৭০ অনুচ্ছেদের কারণে বাংলাদেশের আইন, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসন একজনের হাতে চলে গিয়েছিল। আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ চাই যা জনগণের"।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ এবং ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে। বিশেষ করে, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হলে, সংসদে গঠনমূলক বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।

যারা ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি দেন, তারা বলেন এটি সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং দলত্যাগের মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতা রোধ করে। কিন্তু এই যুক্তি বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট নয়। প্রথমত, গণতন্ত্রের মূল শক্তি হল চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স, যা নিশ্চিত করে যে কোনো একক ব্যক্তি বা দল অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি, তাদের প্রাথমিক দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি, দলের প্রতি নয়। তৃতীয়ত, ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ কার্যত রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছে, যেখানে সরকারি দলের সিদ্ধান্ত বিনা প্রশ্নে পাস হয়ে যায়।

২০২৫ সালের মে-জুন মাসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা হয়েছে। এই সমঝোতা অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা অর্থবিল এবং অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। এটি একটি সন্তুলিত সমাধান, যা একদিকে সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করবে। এই সংস্কার বাস্তবায়িত হলে, সংসদে গঠনমূলক বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে, যা আমাদের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।

আমার সুপারিশ হল, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হোক, তবে সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য অর্থবিল, অনাস্থা প্রস্তাব এবং সংবিধান সংশোধনী বিলের ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা হোক। এছাড়া, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো এবং বিরোধী দলের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করার মাধ্যমে সংসদের কার্যকারিতা বাড়ানো যেতে পারে। এসব সংস্কার বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে এবং জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃত গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করেন, দলের কাছে নয়। ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারের মাধ্যমে আমরা সেই লক্ষ্যের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাব, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য।

 

রাজু

×