ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

একটি সামাজিক বৈপরীত্যের মুখোমুখি বাংলাদেশ

প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে বনাম সামাজিক বাস্তবতা

মুহাম্মদ ওমর ফারুক

প্রকাশিত: ০১:২৮, ২৭ জুন ২০২৫

প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে বনাম সামাজিক বাস্তবতা

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে বিয়েকে ঘিরে একটি প্রচলিত সামাজিক মানসিকতা হলো—মেয়ে পক্ষের ‘প্রথম চাওয়া’ একজন “প্রতিষ্ঠিত পাত্র”। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংজ্ঞা এবং এর জন্য যে সময় ও সংগ্রাম দরকার, তা খুব কম মানুষই গভীরভাবে ভাবেন। বিশেষ করে, বর্তমান সময়ে চাকরির বাজার, উচ্চশিক্ষা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পেশাগত স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে একজন পুরুষের "প্রতিষ্ঠিত" হতে হতে বয়স হয় ৩৫ থেকে ৪০।

এদিকে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের নানা বাস্তবতা যেমন—শারীরিক ক্ষয়, মানসিক স্থবিরতা, দায়িত্বের চাপ, যৌবনের আবেগের ধীরতা—এসবই তাকে প্রভাবিত করে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যেতে থাকে সম্পর্কের প্রতি গভীর টান, উন্মাদনা এবং জৈবিক চাহিদার প্রখরতা।

একজন শিক্ষার্থী যদি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে ৪–৫ বছর পড়াশোনা করেন, এরপর সরকারি বা বেসরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে কয়েক বছর সময় ব্যয় করেন, তাহলে ৩০ বছরের আগেই তার ক্যারিয়ার নিশ্চিতভাবে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা ব্যবসার পথে হাঁটেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠা আরও বিলম্বিত হয়।

অন্যদিকে, মেয়েদের ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে বিয়ের উপযুক্ত বয়স হিসেবে এখনো ২০–২৫ বছরের একটি সময়কাল প্রতিষ্ঠিত। পাত্র যখন ৩৫–৪০, পাত্রী তখন ২০–২৫—এই বয়স ব্যবধান শুধু বয়সের নয়, অভিজ্ঞতা ও মানসিকতা—দুই ক্ষেত্রেই একটি বড় ফাঁড়াক তৈরি করে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষের জীবনের আবেগপূর্ণ ও সম্পর্কনির্ভর সময়কাল মূলত ২০-এর দশকে থাকে। কিন্তু যদি ৩৫–৪০ বছর বয়সে এসে কেউ সম্পর্ক শুরু করেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে আবেগের বদলে চলে আসে দায়িত্ব, ক্লান্তি কিংবা হিসেব-নিকেশ। এমন একজন পুরুষ যদি বিয়ের মাধ্যমে একটি পরিবার শুরু করেন, তখন তাঁর কাছে যৌনতা কিংবা রোমান্টিকতা প্রাধান্য পায় না, বরং এগিয়ে থাকে আর্থিক ব্যালান্স, পারিবারিক চাপ এবং কাজের ক্লান্তি।

অন্যদিকে, বিয়ের পর একজন তরুণী তাঁর সঙ্গীর কাছ থেকে ভালোবাসা, সময় এবং পারস্পরিক আকর্ষণ আশা করেন। কিন্তু এই চাহিদা পূরণ না হলে সেখানেই সম্পর্ক ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি, অসন্তোষ, এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সমাজে ‘প্রতিষ্ঠা’ মানে কেবল অর্থ বা চাকরি নয়—বলা উচিত মানসিক পরিপক্বতা, দায়িত্ববোধ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মেলবন্ধন। আর বিয়েকে যদি যৌথ অভিযাত্রা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ‘প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিয়ে’ নয়, বরং ‘একসাথে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিয়ে’—এই মানসিকতা গড়তে হবে।

‘প্রতিষ্ঠিত পাত্র’ পাওয়া যতটা দরকার, ‘সমবয়সী ও মানসিকভাবে পরিপক্ব একজন জীবনসঙ্গী’ পাওয়া তার চেয়েও বেশি দরকার। সম্পর্ক মানে কেবল আর্থিক নিশ্চয়তা নয়, বরং মানসিক নিরাপত্তা, আন্তরিকতা ও সহযাত্রা। তাই প্রতিষ্ঠা ও সম্পর্ক—এই দুইয়ের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হলে দরকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।

এফএ

×