
রাত আড়াইটা! সামিরা তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। ফেসবুকের নোটিফিকেশন, ম্যাসেঞ্জারের পিক-সব মিলিয়ে তার মনটা আজ ভীষণ ভারি আর অস্থির।
কয়েকদিন আগেই সামিরা ‘সাইবার প্রেম’ নামের একটা ডেটিং ওয়েবসাইটে নিজের প্রোফাইল আপলোড দিয়েছে। আপলোডের দু’দিনের মাথায়ই হামজা নামের এক ছেলে তার সঙ্গে কথা বলেছে। ছেলেটির খাড়া নাক অসম্ভব সুন্দর দুটি চোখ। সব মিলিয়ে ভারি হ্যান্ডসাম। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অবসর পেলে গিটারে সুর তোলে আর কবিতা পড়তে ভালোবাসে।
সামিরা অবশ্য কবিতা-টবিতার ধার ধারে না, কিন্তু হামজার পাঠানো কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইনগুলো তার মনে দাগ কাটে।
তুমি কি কখনো ভেবেছ, ‘আমরা আসলে কতটা সত্যি’-সামিরা দ্রুত টাইপ করে।
হামজা জবাব দেয়, ‘আমরা যতটা সত্যি, যতটা বিশ^াস করি। বাকিটা তো পিক্সেলের খেলা।’
মনিরা প্রাণখুলে হাসে। সাথে সাথেই তার দরজায় টোকা পড়ল। মৃদুপায়ে মা ঘরে প্রবেশ করে বলল, ‘এত রাত পর্যন্ত কী করছিস?’
সামিরা ল্যাপটপ বন্ধ করে হড়বড় করে বলল, ‘অ্যাসাইনমেন্ট মা।’ একটু হেসে মা চলে যায়, কিন্তু সামিরার বুকের ভেতর ধক্ করে ওঠে। কেন সে মাকে মিথ্যা বলল?
পরদিন অফিসে সামিরার কলিগ ফারিহা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার চোখের নিচে কালি মুখ কেমন শুকনো শুকনো! কী হয়েছে?’
সামিরা মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘ওহ কিছু না, রাত জেগে হরর সিরিজ দেখেছিলাম তো।’ ফারিহা পাশের জনের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপাটিপি করে বলে, সিরিজ নাকি সাইবার প্রেমিক?’
সামিরা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে আবার হামজার সাথে চ্যাটে বসে। আজ হামজার মেসেজে একটু বিরক্তি।
‘কাল রাতে তুমি হঠাৎ চলে গেলে যে!।’
সামিরা টাইপ করে, ‘মা ডেকেছিল। তুমি তো জানো আমার ছোট পরিবার। মা, আমি আর আমার ছোটভাই। মা আমাকে ভীষণ কেয়ার করে। আমার বিয়েথা নিয়েও চিন্তিত। কেন এখনো বিয়েতে রাজি হচ্ছি না। আমাকে বিয়ে না দিয়ে ভাইকেও বিয়ে করাতে পারছে না।
হামজা লেখে, ‘আমি জানি। কিন্তু আমি কি শুধুই একটা পিক্সেল, নাকি তোমার জীবনের কেউ?’
সামিরার গলা শুকিয়ে যায়। সে কি এবার সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছে? নাকি শুধু একা থাকার ভয়ে কাউকে চাইছে? তার মনে পড়ে গত বছর তার বান্ধবী তানিশার কী হয়েছিল-সেও একজনের সাথে অনলাইনে প্রেম করেছিল, শেষে দেখা গেল ছেলেটি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে।
সামিরা জবাব দেয় না। রাতজুড়ে তার ফোনে হামজার মেসেজ আসে-
‘তুমি কি আমাকে বিশ^াস করো না, জান? আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, আমার জীবনে তোমাকেই চাই। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। উত্তর দাও প্লিজ।’
ভোররাতের দিকে সামিরা একটা সিদ্বান্ত নেয়। সে হামজাকে লিখে-
‘চল আমরা দেখা করি।’
‘সত্যি বলছ! দেখা করবে?’
‘হুম’
হামজা দ্রুত টাইপ করে, ‘আমি কিন্তু প্রস্তুত, তুমি?’
‘আমিও’ সামিরা জানায়।
অনেক ভেবেচিন্তে তারা শুক্রবার বিকেলে কফি শপে দেখা করার কথা ঠিক করে।
বহুদিন পর ফুরফুরে মেজাজে সামিরা। সব দিক বিবেচনা করে হামজাকে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি নেয় সে।
সামিরা ইট রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছে, হাতে মুখে হালকা মেকাপ। কফি শপের সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখে- একজন লোক এসেছে, কিন্তু সে হামজা নয়। মধ্যবয়স্ক অন্যরকম চেহারার একজন লোক।
খসখসে ত্বকের চোয়াল ভাঙা লোকটি হাসে-
‘সামিরা, চিনতে পারছ না? আমি হামজা।’
যারপর নাই হতভম্ব সামিরা। হা করে শুধু তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে।
মিনমিনিয়ে লোকটি বলে, ‘আসলে আমার প্রোফাইলে পুরানো ছবি দেয়া ছিল তো, তাই...।’
সামিরার হৃদস্পন্দন যেন থেমে যায়। সে চুপচাপ বসে, কফি খায়, কথা বলে না। ফেরার পথে হামজা বলে, ‘আমাদের আবার দেখা হবে তো?’
সামিরা মাথা নাড়ে, কিন্তু মনে মনে জানে এটাই শেষ।
বাড়িতে ফিরে সে প্রোফাইল ডিলিট করে দেয়। রাতের স্ক্রিনের আলোয় তার চোখে পানি জমে, কিন্তু এবার তার ভেতরে এক গভীর উপলব্ধি হয়, সে জানে-প্রেম শুধু পিক্সেলের মায়া নয়, প্রেমে চাই বাস্তবের স্পর্শ।
প্যানেল