
মেহরাব রহমান দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে। ইদানীং নাট্যচর্চা করছেন প্রবাসে ও দেশে। কিন্তু কী সমৃদ্ধি বা পরিবৃদ্ধি এলো তার কবিতায় এতদিনে! জীবনকে তিনি আগাগোড়া নশ্বর এই বিশ্বে সমুদ্রের দূর বাতিঘরের চিহ্ন দেখে আগাগোড়া টেনে নিয়েছেন। সেই কাঁটাতারের বেড়া, ধর্মান্ধতার ইতর জাতীয়তাবোধ, দ্রুতগামী ইঞ্জিনের ঝিক্ ঝিক্ গতির বিমূর্ত ভৈরবী কিংবা দরবারি কানাড়া ঢঙে গান গাওয়ার ধুলোবালি মাখা জীবনই তার কাছে পরম উপাসনা।
মেহরাব রহমান বরাবর তার কবিতায় ধূসর পৃথিবীর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের কয়লা পোড়ার ছাই, চিরচেনা স্টেশন, ভোকাট্টা ঘুড়ি, দূরের জাহাজের ভেঁপু, আগ্নেয়গিরির লাভা, প্রাণের স্বদেশকে রাতের মোহনায় নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। এবারের কাব্যগ্রন্থের তিনি এতদিনের চর্চিত নামের বাইরে এসে ‘আহা পাখি’ নামকরণ করেছেন। আর এই পাখিকে তিনি এবার দেখলেন তার ঘরে ফেরার নেই কোন তাগিদ। তা ছাড়াও এসেছে বর্তমানের স্বদেশ, “গুলি খেয়ে খেয়েও আবু সাইদ স্থবির অনড় দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল/ এতটুকু নতজানু হয়নি সে/ মেরুদণ্ড বিষুব রেখার মতো/ সোজা ছিল” (পৃ-৭৭)। শুদ্ধ কবিদের জগৎ থেকে এবার বোধহয় মেহরাব রহমানকে সামান্য সরে আসতে দেখা যায়। দেখা যায়, শুদ্ধ কবিরা স্থানীয় রাজনীতিতে নিজদের জড়িয়ে ফেলেন না। তাদের কবিতায় সবসময় প্রকৃতি, দেশজ-লোকজ-ঐতিহ্যগত বলয়ে ব্যোমযান চলে। ৩৩টি কবিতা নিয়ে এবারের ৮৫ পৃষ্ঠার মুদ্রিত সংযোজনে কবিতা কন্যা ও অণুর ভিতর পরমাণু নামে দুটি কবিতাগুচ্ছও রয়েছে। কবি মেহরাব রহমান নিত্যদিনের বৈষয়িক চিন্তায় অনিচ্ছুক থেকে শাশ^ত এক “আমি অরণ্য, ঘন সবুজ অনুগামী/ শাখায় শাখায় কাঠবাদামের গন্ধ/ শুঁকে শুঁকে নির্মাণ করি ভালোবাসার অভূতপূর্ব ছন্দ” (পৃ-৩৬)-চর্চা করে যান। তবে “অলৌকিক বিমূর্ত আনন্দ/ মাত্রাহীন স্বরবৃত্ত ছন্দ/ আহা সেই দুরন্ত ওষ্ঠদ্বয়/ আবার যখন অশান্ত হয়/ পরতে পরতে কাঠকয়লার পোড়া আগুন/ ধোঁয়াটে গন্ধ হাতে নিয়ে দেহতে দোঁহাতে/ জলের মতো মিশে যাওয়া/ অবেলার বসন্ত হাওয়া/ যেন সমর্পিত সিজদা/ জায়নামাজে” (পৃ : ৫৩) আরাধনাই তার সনাতন কাব্য অভ্যেস।
সম্প্রতি লন্ডন বা চিকাগো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইংরেজি কবিতাপত্রগুলোতে কবিতার কিছু ভিন্ন সজ্জা দেখা যাচ্ছে। ঠিক সেরকমই মেহরাব রহমানের কবিতাতেও এসেছে সেরকম সজ্জা- “আয়ুষ্কাল কত / তোমার জন্ম পরিধি / কখন কোথায় মৃত্যু / কে জানে / গণমাধ্যমে তোমার অসুস্থতা / কিংবা মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয় কদাচিৎ /” ... (পৃ-১৮)। এমনকি তার কবিতাতেও এসেছে ইংরেজি ছন্দোবদ্ধ চরণ, তবে এটি এর আগেও সাযযাদ কাদির-এর বাংলা কবিতায় দেখা গেছে।
বিশ্বে কবিতার বাগানে অনেক পরিবর্তন এসেছে, সাথে বাংলা কবিতাতেও সম্প্রতি এসেছে কিছু উত্তর-ঔপনবেশিক চিত্রকল্পের বিস্তার। মেহরাব রহমানের কবিতায়ও শুদ্ধতম মননের খরঃযড়মৎধঢ়য থেকে যায়, “কবির মাথা নষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই/ এই কথাগুলো বৃষ্টির সাথে যায় না/ দুঃখিত পাঠক সমাজ/ ক্ষমা চাই/ আমি কবিতার ক্যানভাসে ভুল করে/ অপ্রাসঙ্গিক কিছু ছাপচিত্র এঁকে ফেলেছি/ ডলার শপের সস্তা এক্রেলিক পেইন্টে/ কী করা/ আমাদের এক চিন্তার ঘরে/ ভিন্নচিন্তার ঘুণপোকার/ অনধিকার চর্চা” (পৃ-৪৯)। এভাবে কবি কবিতায় এক ধূসর মাটির ঘ্রাণ বয়ে নশ্বর জীবন নিয়ে অবিনশ্বর ব্যোমকেশে আলবাট্রসের মতো ঝড়ের দিকেই ছুটে চলেছেন।
প্যানেল