
ছবিঃ সংগৃহীত
সময়টা ১৯৯৮ সাল। নিজ এলাকায় উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় আড্ডা দেওয়ার জন্য বেছে নিই ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী এলাকা। সেই আড্ডার সুবাদে জীবনে আসে কিছু ভালো বন্ধু, যারা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে সময় কাটাত, হাসত, গল্প করত। দিনগুলো কেটে যেত প্রাণবন্ততায়।
একদিনের কথা। শীতের রাত, সময় আনুমানিক রাত ৯টা। বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় দুই বন্ধু প্রস্তাব দিল, “চল, চানমারী চকে খেজুর গাছ থেকে রস পেরে খেয়ে আসি।” রোমাঞ্চ আর বন্ধুত্বের টানে আর দেরি করিনি। আমরা প্রায় ১২ জন বন্ধু একসঙ্গে রওনা দিলাম চানমারীর দিকে।
বন্ধুদের সঙ্গে যেকোনো কাজে আমি স্বাভাবিকভাবেই সামনে থেকে অংশ নিতাম—নেতৃত্বের ভূমিকায় যেন নিজেকে খুঁজে পেতাম। সেদিনও সবার আগে ছিলাম। তবে চানমারী চকের কাছাকাছি পৌঁছতেই আচমকা দেখা গেল, ৫-৬ জন মুখে গামছা বাঁধা অচেনা যুবক আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। পরিস্থিতি দেখে বুঝলাম, এরা আক্রমণের উদ্দেশ্যেই এসেছে।
আমি ভয় না পেয়ে পেছনে তাকিয়ে বললাম, “তোরা ভয় পাস না, ওরা সংখ্যায় আমাদের চেয়ে কম—প্রতিবাদ কর!” কিন্তু ফিরে দেখি, পাশে কেউ নেই। সবাই দৌড়ে পালিয়েছে। মুহূর্তেই বুঝলাম, আমি একা। একা একজন দাঁড়িয়ে আছি, আর সামনে ৬ জন হামলাকারী।
ঠিক তখনই একজন বলে উঠল, “ভাই, আপনার বাড়ি কি আলীপুরে?” আমি জবাব দিলাম, “হ্যাঁ, তবে কী?” সে বলল, “তাই তো আপনি বেঁচে গেলেন।” কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ না পেয়েই আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর একে একে ফিরে আসতে থাকলো আমার ‘সাহসী’ বন্ধুরা। কেউ বলল, “ভাই, আমরা তো আসছিলাম তোমাকে বাঁচাতে।” কারও মুখে তখন বড় বড় কথা—যারা একটু আগেই আমাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল।
পরে আমি তাদের ডেকে শুনালাম সেই পুরোনো গল্প—ভাল্লুক আর দুই বন্ধুর গল্পটা। যেখানে বিপদে এক বন্ধু গাছে উঠে পড়ে, আর আরেকজন একা থেকে ভাল্লুকের মুখোমুখি হয়। আমি বলেছিলাম, “বন্ধু মানে কেবল আড্ডা নয়, বিপদে পাশে থাকার নামই বন্ধুত্ব।”
সেই ঘটনার পর আমি অনেকবার চেয়েছি, আমিও যেন ভয় পেলে দৌড়ে পালাতে পারি। কিন্তু জানি না কেন, পারিনি। হয়তো কখনো পারবোও না। আর সেই রাতটাই আমাকে জীবনে এক কঠিন বাস্তবতা শিখিয়েছিল—সবাই বন্ধু হলেও, সবাই ‘সহযোদ্ধা’ নয়।
বিঃদ্রঃ - এই লেখাটি আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। নিছক অতীতের একটি স্মৃতি। কাউকে আঘাত করা বা ছোট করার উদ্দেশে নয়।
মুমু