
ছবিঃ সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের বিস্তার শুরু হওয়ার বহু আগেই সাইকেডেলিক রক ব্যান্ড 'দ্য গ্রেটফুল ডেড' অনলাইন যোগাযোগের শুরুতেই এক অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। শুধু সংগীত নয়, এই ব্যান্ডের প্রভাব বিস্তৃত ছিল প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির অনেক গভীরে।
ব্যান্ড থেকে বিপ্লব: গ্রেটফুল ডেডের যাত্রা
গ্রেটফুল ডেড কেবল একটি ব্যান্ড নয়, ছিল এক বিশাল জীবনধারা। ব্লুজ ব্যান্ড "দ্য ওয়ারলক্স" নামে শুরু করে তারা যুক্ত হন লেখক **কেন কেসির** "অ্যাসিড টেস্ট" অনুষ্ঠানে। এরপর ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে তারা হয়ে ওঠে জাতীয় ট্যুরিং দৃশ্যের অগ্রদূত এবং সান ফ্রান্সিসকোর কাউন্টারকালচারের মুখ।
তাদের ভক্তরা – যাদের "ডেডহেডস" বলা হতো – ব্যান্ডের প্রযুক্তিপ্রীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অনলাইনে এক অভিনব সম্প্রদায় গড়ে তোলে, যা অনেকের মতে ইন্টারনেটের প্রথম ভার্চুয়াল কমিউনিটি।
Whole Earth Catalog থেকে 'The WELL'
১৯৭০-এর দশকে **স্টুয়ার্ট ব্র্যান্ড** Whole Earth Catalog প্রকাশ শুরু করেন, যেখানে "access to tools" স্লোগানের অধীনে আত্মনির্ভরশীল জীবনযাপনের সরঞ্জাম ও চিন্তাধারার বই-লেখা তুলে ধরা হতো। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চর্চা উসকে দেওয়া হতো।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে 'The WELL (Whole Earth ‘Lectronic Link)' নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু হয় – যা ছিল একটি প্রভাবশালী টেক্সট-ভিত্তিক 'Bulletin Board System (BBS)'। এটি ছিল সেই সময়ের তুলনায় বিপ্লবী—একসাথে ৫০ জন ব্যবহারকারী কথা বলতে পারত এখানে।
ডেডহেডদের অনলাইন বিপ্লব
ডেভিড গানস, মেরি আইজেনহার্ট ও বেনেট ফ্যাল্ক মিলে WELL-এ গ্রেটফুল ডেড ফোরাম চালু করেন, যেখানে ডেডহেডরা ব্যান্ড নিয়ে আলোচনা করতেন। অনেকে ট্যুর, টিকিট, লাইভ শো-এর রেকর্ডিং, এমনকি গান ও কবিতা নিয়েও আলাদা আলাদা ফোরামে অংশ নিতেন।
'ডেডহেডদের' উদ্যম এতটাই বেশি ছিল যে, তাদের আলোচনা থেকে অর্জিত অর্থ পুরো WELL প্ল্যাটফর্ম চালাতে সহায়ক হয়েছিল।
জন পেরি বারলো: সাইবারস্পেসের মেয়র
গ্রেটফুল ডেডের গীতিকার **জন পেরি বারলো** পরে WELL-এ সক্রিয় হন এবং অনলাইন গোপনীয়তা ও মুক্ত বক্তৃতার পক্ষে আন্দোলনের এক মুখ্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তিনি **"সাইবারস্পেস"** শব্দটির জনপ্রিয়তা বাড়ান এবং ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন **Electronic Frontier Foundation (EFF)**—যা আজও ডিজিটাল অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
Silicon Valley এবং 'WELL' সংস্কৃতি
WELL-এ শুধু ডেডহেড নয়, ছিলেন প্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, কবি, উদ্যোক্তা এবং হ্যাকাররাও—যেমন:
-স্টিভ ওয়জনিয়াক (Apple)
-ক্রেইগ নিউমার্ক (Craigslist)
-স্টিভ কেস (AOL)
তাদের বিতর্ক, মতবিনিময় এবং সম্মিলিত চিন্তার মাধ্যমে WELL হয়ে ওঠে প্রযুক্তিগত ও সামাজিক পরিবর্তনের এক পরীক্ষাগার।
ছোট কমিউনিটির পতন এবং সামাজিক মাধ্যমের উত্থান
WELL একসময় মাত্র ৫,০০০ ব্যবহারকারী ছিল, কিন্তু এর প্রভাব ছিল অসামান্য। আজ যখন বড় বড় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করে, তখন WELL ছিল এমন এক স্থান যেখানে ব্যবহারকারীরাই ছিল আসল গ্রাহক, ‘পণ্য’ নয়।
'হাওয়ার্ড রেইনগোল্ড' বলেন, "যখন আপনার কমিউনিটির সদস্যরাই পণ্য হয়ে যায়, তখন সেখানে আর কমিউনিটি থাকে না।"
এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
WELL ছিল এমন এক সময়ের প্রতিচ্ছবি, যখন কম্পিউটার বিপ্লবীরা ছিলেন হিপ্পি আন্দোলনের অংশ। সামাজিক মিডিয়ার প্রাক্কালে **The Grateful Dead** এবং তাদের অনুরাগীরাই গড়ে তুলেছিল সেই ভার্চুয়াল কমিউনিটির ভিত্তি, যার রেশ আজও রয়ে গেছে আমাদের অনলাইন জীবনের প্রতিটি কোণে।
গ্রেটফুল ডেড শুধু সংগীতে নয়, বরং প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বিবর্তনেও চিরস্মরণীয় নাম।
মুমু