
আল কুরআনুল কারীম-মানবজাতির প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে দানকৃত শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ। এই কিতাব শুধু কোনো ধর্মীয় পাঠ নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে, পাপ থেকে পবিত্রতায় পৌঁছে দেয় এবং বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেয়। যারা এই কুরআনের আলোকে জীবন গড়েছে, তারা হয়েছে মর্যাদার শিখরে আসীন। যারা তা অস্বীকার করেছে, তারা চিরতরে পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরআনের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনধারায় এক আমূল পরিবর্তন আনেন, পরিণত হন এক আদর্শ ন্যায়বিচারক ও খলিফায়। আবার হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি ছিলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান দাস, কুরআনের শিক্ষায় দীপ্ত হয়ে ওঠেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন ও সম্মানিত সাহাবী। কুরআনই এমন শক্তি, যা জাতি, বর্ণ, শ্রেণি, অবস্থান সব ভেদাভেদ দূর করে এক মহাসমতায় আহ্বান জানায়।
কুরআনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও মুসলিম বিশ্বের প্রতিবাদ
তবে কুরআন যেমন আলো বিতরণ করে, তেমনি ইতিহাসজুড়ে দেখা যায় এর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রও। এরই একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত ঘটে ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল। সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাইকোর্টে উগ্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতার দুই ব্যক্তি—পদ্মপল চোপরা ও শীতল সিং—একটি রিট আবেদন করেন, যাতে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে উসকানিমূলক বলে উল্লেখ করে সেটিকে ভারতে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি পদ্ম খস্তগির সেই আবেদন গ্রহণ করে রাজ্য সরকারকে কৈফিয়ত দিতে বলেন। এ ঘটনা মুহূর্তেই মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বিশেষ করে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ মনে করেন, এটি কেবল কুরআনের বিরুদ্ধে নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর আত্ম-মর্যাদা ও অস্তিত্বের ওপর সরাসরি আঘাত। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ট্র্যাজেডি ও কুরআন প্রেমীদের শাহাদাত
১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে আয়োজিত এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে অন্তত ৮ জন কুরআনপ্রেমী মানুষ শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, কৃষক, দিন-মজুরসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তাদের অপরাধ শুধু এটুকুই ছিল—তারা কুরআনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, আল্লাহর কালামের অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশে-বিদেশে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক চাপ ও মুসলিম জনতার আন্দোলনের মুখে অবশেষে ভারত সরকার হাইকোর্টের সেই রিট আবেদনটি খারিজ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আজও শহীদদের পরিবার বিচার পায়নি, বরং অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, মামলা-হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন।
কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় আমাদের ব্যর্থতা
কুরআনের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, আজ তারা কিয়ামতের ময়দানে আমাদের কাছে প্রশ্ন রাখবেন—“আমরা রক্ত দিয়েছি, আর তোমরা কুরআনকে বইয়ের তাকেই বন্দি করে রেখেছ?” বাস্তবতা হলো, আমাদের অনেকেই কুরআনকে শুধুই তিলাওয়াতের গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করি, কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর নির্দেশনা অনুসরণ করি না। আমরা কুরআনকে চিনি, পড়ি, শুনি—কিন্তু বাস্তব জীবনে কুরআনের অনুপস্থিতিই বেশি চোখে পড়ে।
আজকের সমাজে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, বিশৃঙ্খলা—সবকিছুই কুরআনের শিক্ষা বিসর্জন দেওয়ার ফল। আমাদের উচিত এখনই ফিরে আসা, কুরআনের আলোকে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র গঠন করা।
রাষ্ট্রীয়ভাবে “কুরআন দিবস” ঘোষণার দাবি
বিশ্বে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিন স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবস পালন করা হয়। তাহলে যে দিনে কুরআনের জন্য মানুষ রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন—সেই দিনটি কি আমরা ভুলে যেতে পারি? ১১ মে হওয়া উচিত আমাদের কুরআনের প্রতি ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধের এক প্রতীকী দিন। এ দিনটিকে “কুরআন দিবস” হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
এই দিনে আমরা যেন শুধু শহীদদের স্মরণ না করি, বরং কুরআনের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার শপথ গ্রহণ করি—এমনটাই কাম্য।
আফরোজা