
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদেশ ১৯৭২ বাতিল করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করার প্রস্তাব দিয়েছেন আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এনবিআরের বর্তমান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। যেমন- রাজস্ব আদায়, আয়কর-কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ ইত্যাদি। রাজস্ব নীতি বিভাগ কাজ করবে নীতি প্রণয়নে। দুটি বিভাগই থাকবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এজন্য নতুন অধ্যাদেশ জারি করতে শীঘ্রই অর্থ উপদেষ্টার কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। এনবিআরের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জানুয়ারিতে রাজস্ব খাত সংস্কার কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এনবিআর ভেঙে রাজস্ব নীতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম আলাদা করে নতুন দুটি বিভাগ করার নীতিগত অনুমোদন দেয়। কীভাবে দুটি বিভাগ পৃথক কার্যক্রম পরিচালনা করবে, এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা বা আইন সংশোধন করতে হবে কিনা- তা যাচাই-বাছাই করতে এনবিআর চেয়ারম্যান সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আয়কর ও কাস্টমস উইংয়ের প্রায় ২৫-৩০ জন কর্মকর্তা নীতি ও প্রশাসনিক বিভাগ আলাদা করার আইনি কাঠামো খতিয়ে দেখছেন। এ কমিটি প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের একটি খসড়া তৈরি করেছে, যা শীঘ্রই অর্থ উপদেষ্টার কাছে সারসংক্ষেপ আকারে পাঠানো হবে। বর্তমানে এনবিআর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনাল এবং ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনাল আইআরডির অধীনে পরিচালিত হয়। আইআরডির সচিব পদাধিকারবলে এই চারটি দপ্তরের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পৃথক করে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ সৃষ্টি ও কার্যকর করতে বিদ্যমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদেশ ১৯৭২ রহিত করে নতুন অধ্যাদেশ জারির প্রয়োজন হবে। নতুন অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হলে নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ সৃষ্টি করতে রুলস অব বিজনেস (এলোকশন অব বিজনেসসহ) উভয় ক্যাডারের ক্যাডার রুলস সংশোধন এবং বিভাগ দুটির সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়ন প্রয়োজন হবে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের একটি খসড়ায় দেখা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি বিভাগ কাজ করবে। দুই বিভাগের সচিব হবেন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারে ন্যূনতম ২০ বছর কাজে অভিজ্ঞরা। পালাক্রমে দুই বিভাগে দুই ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তারা কর্মরত থাকবেন। এনবিআরের বর্তমান কাঠামো তখন রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে কার্যক্রম চালাবে। রাজস্ব নীতি বিভাগের মূল কাজ হবে- আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সারচার্জ এবং শুল্ক-করাদি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি প্রণয়ন, সংশোধন ও এসবের ব্যাখ্যা দেওয়া। এছাড়া শুল্ক-কর আরোপ ও অব্যাহতি সংক্রান্ত কার্যক্রম, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী অন্য কার্যক্রম এবং সরকারের দেওয়া অন্য যে কোনো দায়িত্ব পালন করবে। রাজস্ব নীতি প্রণয়নে রাজস্ব নীতি বিভাগকে পরামর্শ দিতে অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অংশীজনদের প্রতিনিধিত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটির কার্যপরিধি নির্ধারণ করবে রাজস্ব নীতি বিভাগ। এছাড়াও কাস্টমস, এক্সাইজ এবং ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনাল এবং আয়কর আপিলাত ট্রাইব্যুনাল রাজস্ব নীতি বিভাগের সংযুক্ত দপ্তর হবে।
অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মূল কাজ হবে- নীতি বিভাগ প্রণীত আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস-শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সারচার্জ আইন ও বিধির প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদ্ধতিগত বিধিমালা প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের বাজেট প্রণয়ন ও বাজেট বাস্তবায়ন এবং লজিস্টিকস সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কাস্টমস সংক্রান্ত চুক্তি আলোচনা, সম্পাদন ও মতামত দেওয়া; আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা; আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন; রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রমের দক্ষতা, কার্যকারিতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আয়কর আপিল এবং কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট সংক্রান্ত আপিল অফিস রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।
ইতোপূর্বে অনেকবার পত্রিকায় লিখেছি যে, পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, এনবিআর বাংলাদেশ তার একটি। ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে যতটা শুল্ক-কর আদায় করে থাকে, ভবিষ্যতে এর চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার কারণ, এ দেশে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জটিল করব্যবস্থা, দুর্বল কর প্রশাসন- এসব কারণেও কর আদায় হয় কম। ফলে সরকারকে বিপুল অর্থ ঋণ করতে হয়।
এদিকে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম গতিশীল করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল গত সরকারের সময়। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। মাঠ পর্যায়ে আয়কর ও কাস্টমসের অফিস সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ৪২ হাজার জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। জনবল বৃদ্ধি ও অফিস সম্প্রসারণের প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়, যা এখনো পূরণ করা হয়ে ওঠেনি। কাস্টমসের প্রস্তাবও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদনকৃত প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কথা ছিল। তাও হয়নি। এ ছাড়া দায়িত্বশীল আয়কর ও কাস্টমস বিভাগ থেকে দুটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল, যা আজও আটকে বলে জানা গেছে। আয়কর অফিস, ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউস গঠন, সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়েছিল গত সরকারের সময়। বলা হয়েছিল কাস্টমস-ভ্যাটের নতুন ১৯টি দপ্তর এবং আয়করের ৪৫টি অফিস স্থাপন করার। একই সঙ্গে কাস্টমস-ভ্যাটে ১৭ হাজার ৩১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আয়করে ২৫ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া ছিল। অর্থাৎ বিগত সরকার রাজস্ব খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেনি। যার ফলে রাজস্ব খাত দুর্বল থেকেই গেছে।
দেশে কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের নিচে। দুই দশক ধরেই কর-জিডিপি অনুপাত পরিস্থিতি ভালো নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জিডিপির আকার যেভাবে বাড়ছে, সেই গতিতে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। জিডিপির তুলনায় কর আহরণের দিক থেকে বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে, বাংলাদেশ তার একটি।
রাজস্ব খাতে সংস্কার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির আকার গত এক দশকে যে হারে বেড়েছে, সেই হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। কর দেওয়া সহজ হয়নি। করদাতার ভয় কাটেনি। আবার বছরের পর বছর কর অব্যাহতির সুবিধা নিয়ে দেশের বহু শিল্প খাতের বিকাশ হয়েছে। কর অব্যাহতির অপব্যবহারও হয়েছে। সংস্কারের উদ্যোগে আসে একশ্রেণির প্রভাবশালীর বাধা। আমরা আশা করছি, অন্তর্র্বর্তী সরকার রাজস্ব খাত সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। শুধু রাজস্ব ফাঁকির দোহাই দিলেই হবে না। প্রয়োজনীয় জনবল, রাজস্ব সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এবং দুর্নীতিমুক্ত রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। বর্তমান সরকার রাজস্ব বিভাগকে যে ভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে, মনে করি তা সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল