
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি বাংলাদেশের অন্য ৬১ জেলার চেয়ে ভৌগোলিক এবং আর্থ-সামাজিক দিক থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। ‘শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন’ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা সদস্যগণ পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সদা তৎপর। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পার্বত্যাঞ্চলের ভিন্নতা সর্বক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, ভাষাগত বৈচিত্র্য, বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, প্রথাগত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ এই অঞ্চলের স্বাতন্ত্র্যবোধের অন্যতম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত সাজেক পর্যটন এলাকা, আলুটিলা, রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রিজ, বান্দরবানের নীলগিরি, বগালেক ও তাজিংডং পাহাড়সহ কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থান এই অঞ্চলের গুরুত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এলাকার আপামর জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ দরিদ্র্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দুর্গম এলাকায় স্থানীয়দের কষ্ট লাঘবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এবং পাহাড়ি-বাঙালি বেকার ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপনে সহায়তা করে আসছে। অপারেশন উত্তরণের আওতায় সেনাবাহিনীর সদস্যগণ মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পাশাপাশি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত রয়েছে। এতে করে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ উন্নত হচ্ছে।
তিন পার্বত্য জেলার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা নজরদারির আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনায় দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাসদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ১০৩৬ কিমি সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করেছে, যার প্রথম পর্বে ৩১৭ কিমি সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম চলমান। তিন পার্বত্য জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অনগ্রসর এই অঞ্চলে এসেছে উন্নয়ন ও প্রাণের স্পন্দন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্প, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে পাহাড়ি জনপদ বর্তমানে উন্নত জীবনযাত্রার দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগের জন্য স্থাপিত হয়েছে মোবাইল টাওয়ার। জনগণ পেয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। যার মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলে এসেছে আধুনিকতার ছাপ। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কারণে এ সব সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রমে পার্বত্য তিন জেলায় যোগাযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং রাত্রিযাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় সৌন্দর্য পিপাসু হাজারো মানুষ এখন পার্বত্য তিন জেলায় বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নির্মিত নীলগিরি, সাজেক, থানচি, রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই লেকে রিসোর্ট এবং ৮০ কিমি দীর্ঘ অতি গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভটি পর্যটন শিল্প বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। রেমাক্রী, বড়পাথর, নাফাখুম জলপ্রপাত, শুভলং জলপ্রপাত, বগা লেক, আলুটিলা, চিম্বুক, স্বর্ণমন্দির প্রভৃতি এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে পর্যটন শিল্প বর্তমানে যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে।
॥ দুই ॥
দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় অনেক পরিবার দীর্ঘদিন ধরে পানির সমস্যায় ভুগছিল। সেখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়, যা ৫০০ মিটার গভীর থেকে সাব মারসিবল পাম্পের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হয় এবং সেখান থেকে স্থানীয় জনসাধারণ সুপেয় পানি সংগ্রহ করে থাকে। এই প্রকল্প চালুর পর পানির সমস্যা সমাধান হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর অনন্য ভূমিকার যথেষ্ট প্রশংসা করেছে। পাহাড়ের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন হলে সবার আগে ছুটে আসে সেনাসদস্যরা। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাহাড়ি মানুষের পাশে সেনাসদস্যরা হাসিমুখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়, বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আস্থা অর্জন এবং সম্প্রীতি বজায়ে তিন পার্বত্যাঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষের কাছে সেনাবাহিনী নির্ভরতার প্রতীক।
পার্বত্যাঞ্চলে চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিছুদিন পূর্বে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার হাজাপাড়া নামক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মহামারি আকারে ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই সময়ে কিছু পাহাড়ি যুবক, বৃদ্ধা ও শিশু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সেখানে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে হাতিরমাথা অতিক্রম করে হাজাপাড়া এলাকায় গমনকরত সেখানে অতি দ্রুত অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প নির্মাণ করে অনেক মহামারি আক্রান্ত রোগীদের পরম যত্নের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে সুস্থ করে তোলেন। কঠিনতম প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করে দুর্গম ওই অঞ্চলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের করোনায় যখন সারাদেশের মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটির দুর্গম অঞ্চলের অসুস্থ লোকজনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে চিকিৎসার সুব্যবস্থা করেছে। চিকিৎসা সহায়তা করার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল টিম বিনামূল্যে নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পেনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পাহাড়ি বাঙালিদের মাঝে ফ্রি চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি সেনাবাহিনী সেখানকার বসবাসরত লোকজনের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। তথ্য অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ি বাঙালিদের মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ শীতবস্ত্র, খেলাধুলা সামগ্রী, শিক্ষা উপকরণ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও হতদরিদ্রদের মাঝে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে চক্ষুশিবির নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। এসব চক্ষুশিবিরে দুর্গম পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ি ও বাঙালির চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষু সেবা গ্রহণ করছে। ইতোপূর্বে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রাঙ্গামাটির সাজেক ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় হাম আক্রান্ত হয়ে বহু পাহাড়ি শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। এসব আক্রান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সুপেয় পানি সরবরাহ, খাবার ব্যবস্থা, অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প করে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে পাহাড়িদের জীবন বাঁচানোর মতো মানবিক কাজে সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের দুর্গম স্থানগুলোতে গর্ভবতী মুমূর্ষু নারীদের পাহাড়ি রাস্তায় কাঁধে করে এনে হেলিকপ্টারযোগে সিএমএইচ এ নিয়ে সন্তান প্রসবসহ সুস্থ করে তোলার নজিরও রয়েছে অহরহ।
শিক্ষা বিস্তারেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। তিন পার্বত্যাঞ্চলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থাপিত এবং পরিচালিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে অসংখ্য পাহাড়ি বাঙালি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে পাহাড়ি বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের উন্নতমানের পড়ালেখা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায়ও সেনাবাহিনী এগিয়ে আছে। বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মীয় উপাসনালয় গড়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। অবহেলিত শিশুদের মানসিক বিকাশে তাদের জন্য সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অনেক স্কুলে পড়ালেখার বই, শিক্ষা উপকরণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নেই। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উপকরণ, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের অবহেলিত মানুষদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণসহ ওই বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করছে। দুর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী প্রতিবছর নানা দিবসে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তাদের এসব কার্যক্রম, মুক্তবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চর্চা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বে সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে।
॥ তিন ॥
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল অনগ্রসর ও অন্ধকারাচ্ছন্ন এক অঞ্চল। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে গুইমারা সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে গুইমারা রিজিয়নের পুরানো কমান্ডার বাংলোতে একটি কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করা হয়। এতে কিছু বাঙালি ও পাহাড়ি ব্যক্তিবর্গ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই কল্পনাও করেনি যে, এসব অঞ্চলে পানি আসবে, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সমস্যার সমাধান হবে। অথচ কল্পনা আজ সত্যি হয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথে ঘটেছে উন্নয়ন। প্রান্তিক চাষিগণ প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহনে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখছে। দুর্গম পাহাড়ে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের আলো, রাস্তা করা হয়েছে প্রশস্ত। বেড়েছে কৃষিকাজ, চাষাবাদ। বিশেষ করে কাজুবাদাম, কফি, মালটা, চুই ঝাল ইত্যাদি ফসল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়ায় পাহাড়ি বাঙালি কৃষকরা লাভবান হচ্ছে।
এলাকায় পর্যটন খাতেও উন্নতির দুয়ার খুলে গিয়েছে। সেখানে বাড়ছে বিনিয়োগ। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখন চলছে উন্নয়নযজ্ঞ। আইএসপিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য তিন জেলাতে যোগাযোগের উপযোগী রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সড়ক যোগাযোগের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার। শান্তিচুক্তির পূর্বে তিন পার্বত্য জেলায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ছিল মাত্র ২৪টি। এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে ২৭০টির বেশি। যাত্রী ছাউনি ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। সীমান্ত সড়ক নির্মাণসহ এমন রাস্তা সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো ছিল এক সময় অরক্ষিত। বলা যায়, সন্ত্রাসী আর উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য বিস্তারজনিত সশস্ত্র কার্যকলাপে প্রায়ই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটত। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি, যার অধিকাংশই বাস্তবায়ন ছিল অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে শান্তিচুক্তি অনেকটাই আলোর মুখ দেখেছে।
পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নে সেনা কর্মকর্তা-সৈনিক সকলেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে আসছে। এ সব কাজে তাদের মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে। ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের উদ্ধার অভিযানে দুজন অফিসার এবং তিন সেনাসদস্য মৃত্যুবরণ করেন এবং ১০ জন সেনাসদস্য গুরুতর আহত হন। দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য মনে করেই অকুতোভয় সেনা সদস্যগণ সেদিন এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে এসে আজ অবধি বহু সেনা সদস্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমণে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিকা অপরিসীম। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, নিরাপত্তা, পড়ালেখাসহ সার্বিকভাবে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। ক্রমেই পার্বত্যাঞ্চল দেশের অন্যান্য জেলার মতো আধুনিক শহরে পরিণত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্যাঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন দেশ ও জাতির নিকট একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা
প্যানেল