ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

নতুন পোপ কার্ডিনাল রবার্ট ফ্রান্সিস প্রভোস্ট

জ্যাষ্টিন গোমেজ

প্রকাশিত: ১৮:২০, ১০ মে ২০২৫; আপডেট: ১৮:২১, ১০ মে ২০২৫

নতুন পোপ কার্ডিনাল রবার্ট ফ্রান্সিস প্রভোস্ট

রোম শহরের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার উপরে জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল ক্রুশটি। হাজারো মানুষ প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে ছিল। ঘণ্টার ধ্বনি আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়, যেন ঘোষণা দিচ্ছে। বিশ্ব একটি নতুন পোপ পেয়েছে। আর এই যাত্রা শুরু হলো বিশ্বাস, দায়িত্ব ও ভালোবাসার সঙ্গে। সারা বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর ১৩৩ জন কার্ডিনাল নতুন পোপ নির্বাচন করেছেন। ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন নাগরিক পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কার্ডিনাল রবার্ট ফ্রান্সিস প্রভোস্ট গত ৯ মে ২০২৫ সালে নতুন পোপ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে পোপ  চতুর্দশ লিও  নাম গ্রহণ করেছেন।  তিনি হলেন ইতিহাসের ২৬৭তম পোপ। প্রথমবারের মতো সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঐতিহাসিক বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হাজারো উৎসাহী মানুষের মাঝে ইতালীয় ভাষায় তিনি বলেন, ‘প্রিয় ভাই ও বোনেরা, তোমাদের সকলের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এটি পুনরুত্থিত খ্রিস্টের প্রথম সম্ভাষণ। আমি চাই এই শান্তির বার্তা পৌঁছে যাক তোমাদের পরিবারে, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে।’ এছাড়াও তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসকে এবং বলেন, মানবতার জন্য আজ যিশু খ্রিস্টের প্রয়োজন, যিনি ঈশ্বর ও মানবের মাঝে সেতু। তিনি আমাদের সাহায্য করুন, এবং একে অপরকে সাহায্য করুন এই সেতু নির্মাণে।’
৬৯ বছর বয়সী রবার্ট প্রেভোস্টের জন্ম শিকাগোতে হলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে একজন মিশনারি হিসেবে। মাত্র ২০২৩ সালে তাকে কার্ডিনাল ঘোষণা করা হয়। তিনি প্রচারমাধ্যমে খুব কমই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এবং জনসম্মুখেও তেমন কথা বলেন না। গত মাসে দীর্ঘ ১২ বছর পর মারা যান পোপ ফ্রান্সিস। তিনি ছিলেন প্রথম লাতিন আমেরিকান পোপ। তার আমলে ক্যাথলিক চার্চে আধুনিকতা ও খোলামেলা আলোচনার ধারার সূচনা হয়। ফ্রান্সিস নারী ধর্মযাজকতা ও এলজিবিটি ক্যাথলিকদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্কের সুযোগ দেন, যা ঐতিহ্যবাদীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। নতুন পোপ নির্বাচনের আগে কিছু কার্ডিনাল ফ্রান্সিসের সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিকতা চাইলেও, কেউ কেউ চেয়েছেন ঐতিহ্যে ফিরে যেতে। পোপ লিও চতুর্দশ এই দুটি ধারার কোনটি বেছে নেবেন, সে দিকেই এখন নজর বিশ্ব ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের। তবে তিনি একজন নম্র কিন্তু দৃঢ় নেতা হিসেবে পরিচিত, যিনি গির্জার আধুনিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় পোপ ফ্রান্সিসের সংস্কার নীতিকে সমর্থন করেন।

সর্বজনীন বার্তা
সারা বিশ্ব এখন পোপের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে রয়েছে একজন নৈতিক পথপ্রদর্শক হিসেবে। তার বার্তাগুলো যদি মানবতার পক্ষে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং নৈতিকতার পক্ষে হয় তবে তা ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্ববাসীর মাঝে আশার আলো জ্বালাবে। বর্তমান বিশ্ব এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি; মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও গাজা অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ প্রতিদিন অসংখ্য নিরীহ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনা নতুন করে এশিয়াজুড়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আরও অস্থির করে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন পোপ জন পল তৃতীয়ের উচিত হবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে স্পষ্ট ও জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা। পোপের কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক নয়, কিন্তু নৈতিক। ঠিক এই কারণেই তার আহ্বান বিশ্বজুড়ে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছায়। তিনি যদি যুদ্ধ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় বার্তা দেন, তাহলে সকল মানবতার পক্ষেই শক্তি ও সাহস জোগাবে। নতুন পোপের আরেকটি বড় দায়িত্ব হবে বিশ্ববাসীকে মানবিকতা, সহানুভূতি, সততা ও আন্তরিকতার পথে আহ্বান জানানো। কেননা শুধু যুদ্ধই নয়, আজকের পৃথিবীতে নৈতিক অবক্ষয়ও এক বড় সংকট। মানুষ মূল্যবোধ থেকে সরে যাচ্ছে। মিথ্যা, লোভ, সহিংসতা, বিভেদ ও অশালীনতার বিস্তার পরিবার, সমাজ এবং জাতির ভেতরেই ভাঙন সৃষ্টি করছে। নতুন পোপ যদি নৈতিকতার এই দিকগুলোতে কার্যকরভাবে মনোযোগ দেন, তবে বিশ্বজুড়ে তরুণ সমাজসহ সব শ্রেণির মানুষ তার নেতৃত্বে আলোর দিশা খুঁজে পাবে।

নতুন পোপের সামনে অপেক্ষা করছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ
নতুন পোপ এমন এক সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করছেন, যখন ক্যাথলিক চার্চের সামনে রয়েছে একাধিক জটিল ও সংবেদনশীল চ্যালেঞ্জ। শুধু ধর্মীয় নেতৃত্ব নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যেমনÑ পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মচর্চার ক্রমহ্রাস: ইউরোপ ও আমেরিকাসহ পশ্চিম বিশ্বের অনেক দেশেই ক্রমাগত ধর্ম থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। আর একে বলা হয় ‘সেকুলারাইজেশন’ বা ধর্মহীনতার উত্থান। তরুণ প্রজন্ম গির্জা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এবং সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবর্তে ভোগবাদী ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাচ্ছে। নতুন পোপকে এসব সমাজে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে নতুন কৌশল নিতে হবে। জলবায়ু সংকট ইস্যু : পৃথিবী এখন জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি। পোপ ফ্রান্সিস এই ইস্যুকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। নতুন পোপকে সেই ধারা আরও শক্তিশালী করে পরিবেশ সংরক্ষণে বিশ্বাসীদের সচেতন ও সক্রিয় করতে হবে। কেননা এটি শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, বরং নৈতিকতার বিষয় বলেই ক্যাথলিক সামাজিক শিক্ষায় গুরুত্ব পায়। সংস্কার বনাম ঐতিহ্যের দ্বন্দ্ব : চার্চের ভেতরে এক শ্রেণি চায় আরও উদারনীতি ও আধুনিকতা যেমন নারীদের ভূমিকায় সম্প্রসারণ বা বিবাহিত যাজকদের অনুমোদন। অপরদিকে, আরেকটি অংশ ঐতিহ্য ও রক্ষণশীলতার পক্ষে। এবারের নতুন পোপের সামনে রয়েছে এই দুই পক্ষের ভারসাম্য রক্ষা করার দায়িত্ব। যাতে চার্চে ঐক্য থাকে এবং বিশ্বাসীরা বিচ্ছিন্ন না হয়। আশা, ঐক্য ও এক নতুন যাত্রা : রবার্ট ফ্রান্সিস প্রভোস্ট এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্যাথলিক চার্চ নতুন একটি অধ্যায়ে প্রবেশ করল। সংকট ও প্রতীক্ষার মধ্যেও সিস্টীন চ্যপেলের সাদা ধোঁয়া গোটা পৃথির্বতে জানান দিলো, ধর্মীয় নেতৃত্ব এখনো মানবতা, ন্যায় ও শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই এবারের নতুন পোপের নেতৃত্ব নিয়ে আমরা সবাই আশাবাদী। মনে করি তিনি তার পূর্বসূরি ফ্রান্সিসের মতোই সাম্য, সহানুভূতি ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকবেন। নতুন পোপের জন্য আমাদের প্রার্থনা থাকবে। আশা করছি তিনি দরিদ্র ও অবহেলিতদের পক্ষে কথা বলেন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিপীড়িতদের পাশে থাকবেন। পোপ ফ্রান্সিস গত ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সরল জীবনযাপন, সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির আহ্বান শুধু খ্রিস্টানদের মাঝেই নয়, বরং মুসলিমসহ নানা ধর্মের মানুষের কাছেও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। নতুন পোপের জন্য আমাদের প্রার্থনা ও শুভ কামনা থাকবে। আশা করছি তিনি দরিদ্র ও অবহেলিতদের পক্ষে কথা বলেবেন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিপীড়িতদের পাশে থাকবেন।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

প্যানেল

×