২৯ অক্টোবরের ট্র্যাজেডি। ৫০৪ জন বিখ্যাত লোকের রহস্যজনক মৃত্যু। সাড়া পড়ে বিশ্বে। অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সবাই। প্রতেক্যেই নিজ নিজ জায়গায় রাতে সুস্থ শরীরে ঘুমিয়ে সকালে জেগে ওঠেননি। কেউই সাধারণ নন। সেনা বাহিনীর উচ্চপদস্থ জেনারেল, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ লোক, গণমাধ্যেেমর বিখ্যাত সব সাংবাদিক। সবার বায়োডাটায় একটি জিনিস কমন, সবাই দেশের নিরাপত্তা ও অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বজয়ী ডিটেকটিভরা কোমর বেঁধে নামে। কিন্তু কূলকিনারা কিছুই করতে পারে না।
দুবছর পর। বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল পত্রিকা অফিসের কীবোর্ডের ঠকঠক শব্দ। মোহাম্মদ রাফির বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু দৃষ্টি একেবারে তীক্ষ্ণ। শহরের গুটিকয়েক সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একজন সে। পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার তিনি।
এক সন্ধ্যায় একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে তার ফোনে?
– “আপনি কি মোহাম্মদ ওাফি?”
– “হ্যাঁ, বলুন।”
– “কাল রাত তিনটায় জাতীয় গ্রন্থাগারের পেছনে আসবেন। কিছু আছে, যা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি সাহস থাকে, আসবেন।”
তারপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন। রাফি অবাক হয়, কল আসছে অথচ কোন নাম্বার নেই। সেই গম্ভীর কণ্ঠ- ঠান্ডা, অনুশীলিত, যেন কোনো থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট পড়ে শুনিয়েছে?
পরদিন গভীর রাতে, রাফি যখন সেই নির্জন জায়গায় পৌঁছায়, বৃষ্টির ছাঁট তখনো পড়ছিল। হঠাৎ একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে, অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। হাতে একটি বাদামি খাম।
– “এই ফাইলটা... এটা আপনার সত্যি দরকার হবে... ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ বলে একটা টার্ম শুনেছেন?”
– “না।”
– “শুনবেন... কিন্তু হয়তো বাঁচবেন না।”
ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে যায়। রাফি খাম খুলে দেখে সেখানে একাধিক সিক্রেট ক্যাবিনেট মিটিং-এর নথি, ভুয়া ঘএঙ-এর অর্থপ্রাপ্তির রেকর্ড, ও একটি লিস্ট: “ভবিষ্যৎ ঝুঁকির তালিকা”- সবার নিচে তার নিজের নাম!
ঘরের দরজা বন্ধ করে মোহাম্মদ রাফি ফাইলগুলো বিছানার ওপর ছড়িয়ে দেয়। বাতি নিভিয়ে, কেবল ডেস্ক ল্যাম্প জ্বেলে পড়ে সে এক এক করে। নথিগুলো পুরাতন টাইপ রাইটারে লেখা, কিছু জায়গা কালি ফেটে উঠে গেছে। মাঝে মাঝে ইংরেজি আর বাংলার অদ্ভুত মিশ্রণ-“Strategic Elimination under Shadow Protocol B”, “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন ক্লিনজিং প্রোগ্রাম”, “অভ্যন্তরীণ শত্রু নিধন প্রকল্প: মডেল ‘চিহ্নিত রক্ত’। রাফির গলা শুকিয়ে আসে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা পেইজ: মেমো নম্বর: CMÑSX/11 প্রেরক: ছায়া মন্ত্রিসভা, দপ্তর: গোপন অভ্যন্তরীণ স্থিতি। বিষয়: পর্যবেক্ষণ ও অপসারণ - MMZ (Mohammad Zari)
রাফির দেহ শীতল হয়, সে নিজেই টার্গেট! কিন্তু কে পাঠিয়েছে এগুলো? কেন পাঠিয়েছে? বিছানার পাশে রাখা ফোনটা হঠাৎ করে অনবরত কম্পন করতে শুরু করে। স্ক্রিনে কিছু আসে না, শুধু ব্ল্যাক স্ক্রিন। এরপর ভেতর থেকে এক ভয়ানক চাপা গলার রেকর্ডেড শব্দ:
– “তুমি যা পেয়েছো, তা জানার অনুমতি তোমার ছিল না। এখন ফেরার পথ নেই। তুমি দেখবে তারা কেমন।” সঙ্গে সঙ্গে ফ্যান নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়। ঘর ঠান্ডা হয়ে আসে। জানালার পর্দা কাঁপতে থাকে, যেন বাইরের অন্ধকার ভেতরে ঢুকতে চাইছে। রাফি চিৎকার করে উঠে- কে আছো?” কোনো উত্তর নেই। শুধু দেওয়ালের দিক থেকে একটা চাপা ফিসফিস- “আমরা তো সবখানেই আছি... ছায়া কোথায় নেই?”
ঢাকার গলিঘুঁজির ভেতরে এক সময়কার আলোচিত মন্ত্রী রাশিদ খসরু-এর পুরনো বাসভবন। এখন সেখানে কেউ থাকে না। কেবল একটা কেয়ারটেকার, যে বলে, “স্যার কারো সঙ্গে দেখা করেন না।”
কিন্তু মোহাম্মদ রাফিকে দেখে সে চুপ হয়ে যায়।
“আপনি... আপনি কি রাফি সাহেব?” কেয়ারটেকার ধীরে বলে।
রাফি কাঁধে ঝোলা টেনে হ্যাঁ বলে।
“স্যার আপনার জন্য ওয়েট করছেন।”
রাফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কীভাবে জানেন আমি আসছি?
কেয়ারটেকার একটা শুকনো হাসি হেসে বললো, -উনি সব জানেন, ওনাকে জানতে হয়।
একটা হুইলচেয়ারে বসে আছেন রাশিদ খসরু-চোখে কালো চশমা, মুখভর্তি দাড়ি।
-তুমি এসে গেছ, রাফি?
-আমি ২৯ জুলাই সম্পর্কে জানতে চাই মি. খসরু।
বৃদ্ধ হোহো করে হেঁসে উঠে। জানলে মৃত্যু আসে। ঐ ৫০৪ জন, ওরা জেনেছিল।
রাফি থমকে যায়।
“ছায়া মন্ত্রিসভা কি সত্যিই আছে?”
খসরু হাসেন না, কাঁপা গলায় বলেন-
“ওটা আসলে নেই- এই ‘না থাকা’ই ওদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
তুমি জানো কারা সত্যকে বেশি জানে? মৃতরা। আর ওরা মৃতদের নিয়েই সরকার চালায়।”
“মানে?”
“ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেউ বেঁচে নেই- কাগজে নেই, টিভিতে নেই, তবে আদেশ দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে। এরা তথ্যের গভীরে বাস করে, ডেটা, মনিপুলেশন, এবং হরর দিয়ে কাজ চালায়।”
হঠাৎ করেই ছাদের আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। একটা ছায়ামূর্তি রাশিদ খসরুর পেছনে এসে দাঁড়ায়-
চেহারা নেই, শুধু ঝাপসা কালো কুয়াশার মতো আকৃতি।
“তুমি বেশি জেনে গেছো রাফি।” খসরুর চোখ দুটো ফাঁকা হয়ে যায়। শরীর ধীরে ধীরে গলে যেতে থাকে।
ছায়াটা হাসে।