
২৯ অক্টোবরের ট্র্যাজেডি। ৫০৪ জন বিখ্যাত লোকের রহস্যজনক মৃত্যু। সাড়া পড়ে বিশ্বে। অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সবাই। প্রতেক্যেই নিজ নিজ জায়গায় রাতে সুস্থ শরীরে ঘুমিয়ে সকালে জেগে ওঠেননি। কেউই সাধারণ নন। সেনা বাহিনীর উচ্চপদস্থ জেনারেল, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ লোক, গণমাধ্যেেমর বিখ্যাত সব সাংবাদিক। সবার বায়োডাটায় একটি জিনিস কমন, সবাই দেশের নিরাপত্তা ও অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বজয়ী ডিটেকটিভরা কোমর বেঁধে নামে। কিন্তু কূলকিনারা কিছুই করতে পারে না।
দুবছর পর। বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল পত্রিকা অফিসের কীবোর্ডের ঠকঠক শব্দ। মোহাম্মদ রাফির বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু দৃষ্টি একেবারে তীক্ষ্ণ। শহরের গুটিকয়েক সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একজন সে। পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার তিনি।
এক সন্ধ্যায় একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে তার ফোনে?
– “আপনি কি মোহাম্মদ ওাফি?”
– “হ্যাঁ, বলুন।”
– “কাল রাত তিনটায় জাতীয় গ্রন্থাগারের পেছনে আসবেন। কিছু আছে, যা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি সাহস থাকে, আসবেন।”
তারপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন। রাফি অবাক হয়, কল আসছে অথচ কোন নাম্বার নেই। সেই গম্ভীর কণ্ঠ- ঠান্ডা, অনুশীলিত, যেন কোনো থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট পড়ে শুনিয়েছে?
পরদিন গভীর রাতে, রাফি যখন সেই নির্জন জায়গায় পৌঁছায়, বৃষ্টির ছাঁট তখনো পড়ছিল। হঠাৎ একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে, অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। হাতে একটি বাদামি খাম।
– “এই ফাইলটা... এটা আপনার সত্যি দরকার হবে... ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ বলে একটা টার্ম শুনেছেন?”
– “না।”
– “শুনবেন... কিন্তু হয়তো বাঁচবেন না।”
ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে যায়। রাফি খাম খুলে দেখে সেখানে একাধিক সিক্রেট ক্যাবিনেট মিটিং-এর নথি, ভুয়া ঘএঙ-এর অর্থপ্রাপ্তির রেকর্ড, ও একটি লিস্ট: “ভবিষ্যৎ ঝুঁকির তালিকা”- সবার নিচে তার নিজের নাম!
ঘরের দরজা বন্ধ করে মোহাম্মদ রাফি ফাইলগুলো বিছানার ওপর ছড়িয়ে দেয়। বাতি নিভিয়ে, কেবল ডেস্ক ল্যাম্প জ্বেলে পড়ে সে এক এক করে। নথিগুলো পুরাতন টাইপ রাইটারে লেখা, কিছু জায়গা কালি ফেটে উঠে গেছে। মাঝে মাঝে ইংরেজি আর বাংলার অদ্ভুত মিশ্রণ-“Strategic Elimination under Shadow Protocol B”, “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন ক্লিনজিং প্রোগ্রাম”, “অভ্যন্তরীণ শত্রু নিধন প্রকল্প: মডেল ‘চিহ্নিত রক্ত’। রাফির গলা শুকিয়ে আসে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা পেইজ: মেমো নম্বর: CMÑSX/11 প্রেরক: ছায়া মন্ত্রিসভা, দপ্তর: গোপন অভ্যন্তরীণ স্থিতি। বিষয়: পর্যবেক্ষণ ও অপসারণ - MMZ (Mohammad Zari)
রাফির দেহ শীতল হয়, সে নিজেই টার্গেট! কিন্তু কে পাঠিয়েছে এগুলো? কেন পাঠিয়েছে? বিছানার পাশে রাখা ফোনটা হঠাৎ করে অনবরত কম্পন করতে শুরু করে। স্ক্রিনে কিছু আসে না, শুধু ব্ল্যাক স্ক্রিন। এরপর ভেতর থেকে এক ভয়ানক চাপা গলার রেকর্ডেড শব্দ:
– “তুমি যা পেয়েছো, তা জানার অনুমতি তোমার ছিল না। এখন ফেরার পথ নেই। তুমি দেখবে তারা কেমন।” সঙ্গে সঙ্গে ফ্যান নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়। ঘর ঠান্ডা হয়ে আসে। জানালার পর্দা কাঁপতে থাকে, যেন বাইরের অন্ধকার ভেতরে ঢুকতে চাইছে। রাফি চিৎকার করে উঠে- কে আছো?” কোনো উত্তর নেই। শুধু দেওয়ালের দিক থেকে একটা চাপা ফিসফিস- “আমরা তো সবখানেই আছি... ছায়া কোথায় নেই?”
ঢাকার গলিঘুঁজির ভেতরে এক সময়কার আলোচিত মন্ত্রী রাশিদ খসরু-এর পুরনো বাসভবন। এখন সেখানে কেউ থাকে না। কেবল একটা কেয়ারটেকার, যে বলে, “স্যার কারো সঙ্গে দেখা করেন না।”
কিন্তু মোহাম্মদ রাফিকে দেখে সে চুপ হয়ে যায়।
“আপনি... আপনি কি রাফি সাহেব?” কেয়ারটেকার ধীরে বলে।
রাফি কাঁধে ঝোলা টেনে হ্যাঁ বলে।
“স্যার আপনার জন্য ওয়েট করছেন।”
রাফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কীভাবে জানেন আমি আসছি?
কেয়ারটেকার একটা শুকনো হাসি হেসে বললো, -উনি সব জানেন, ওনাকে জানতে হয়।
একটা হুইলচেয়ারে বসে আছেন রাশিদ খসরু-চোখে কালো চশমা, মুখভর্তি দাড়ি।
-তুমি এসে গেছ, রাফি?
-আমি ২৯ জুলাই সম্পর্কে জানতে চাই মি. খসরু।
বৃদ্ধ হোহো করে হেঁসে উঠে। জানলে মৃত্যু আসে। ঐ ৫০৪ জন, ওরা জেনেছিল।
রাফি থমকে যায়।
“ছায়া মন্ত্রিসভা কি সত্যিই আছে?”
খসরু হাসেন না, কাঁপা গলায় বলেন-
“ওটা আসলে নেই- এই ‘না থাকা’ই ওদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
তুমি জানো কারা সত্যকে বেশি জানে? মৃতরা। আর ওরা মৃতদের নিয়েই সরকার চালায়।”
“মানে?”
“ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেউ বেঁচে নেই- কাগজে নেই, টিভিতে নেই, তবে আদেশ দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে। এরা তথ্যের গভীরে বাস করে, ডেটা, মনিপুলেশন, এবং হরর দিয়ে কাজ চালায়।”
হঠাৎ করেই ছাদের আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। একটা ছায়ামূর্তি রাশিদ খসরুর পেছনে এসে দাঁড়ায়-
চেহারা নেই, শুধু ঝাপসা কালো কুয়াশার মতো আকৃতি।
“তুমি বেশি জেনে গেছো রাফি।” খসরুর চোখ দুটো ফাঁকা হয়ে যায়। শরীর ধীরে ধীরে গলে যেতে থাকে।
ছায়াটা হাসে।
॥ দুই ॥
একটি পুরনো গোরস্তানের মাঝে আগুন জ্বলছে। চারজন ছায়ামূর্তি বসে আছে সেই শিখা ঘিরে। গভীর রাতের সেই ঘন অন্ধকার ঢেলে সে দিকেই এগুলো রাফি। ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয় ছায়াদের চেহারা। ওদের চোখে বহু পুরনো ক্লান্তি, মুখে বিষণ্নতা। একমাত্র মহিলাটি চোখ বড় করে তাকায় রাফির দিকে।
“তুমিই রাফি?”
“হ্যাঁ।”
“আমরা তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। অনেক জেনে গেছো, যা উচিত হয়নি। এখন মৃত্যু থেকে তোমাকে কে বাঁচাবে।”
“কেন? কেঁপে ওঠে রাফির ঠোঁট।
“এটাই ছায়া সরকারের নিয়ম, যে জানে সে মরে।”
“তোমারা ওদের লোক? কিন্তু আমার তথ্যমতে তোমরা তা নও, তোমরা বিদ্রোহী।”
-“ওরা আমাদের খুঁজছে। কিন্তু ওরা আমাদের পাবে না। আমরা অধরা। কিন্তু তুমি সেটা নও, ওরা তোমায় খুঁজে পাবে।”
-“আমি চাই তোমরা আমাকে সাহায্য কর। সেই ৫০৪ মৃত্যু আর কথিত সেই ছায়া মন্ত্রিসভার রহস্য।”
-“তোমার প্রাণবন্ত রক্তমাংসের দেহ নিয়ে ছায়ার বিরুদ্ধে লড়বে? এটা সম্ভব নয়।”
-“তোমরা জীবিত নও?”
-“তা জেনে তোমার কাজ নেই, ছায়ার বিরুদ্ধে ছায়ারাই লড়তে পারে, তুমি নও।”
-“আমাকে এই রহস্য জানতে হবে।”
-“তাহলে মরো, মৃতরা সব রহস্য জানে।”
-“কিন্তু কোন লাভ হয় না। মৃতরা জেনে কিছুই করতে পারে না। আমি রক্তমাংসের দেহেই সেই রহস্য উদ্ঘাটন করব।”
-“কে বলল পারে না? ছায়া মন্ত্রিসভা কি না করছে? মানুষের কোন কর্মকাণ্ডে তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই?”
-অযথা বকা বন্ধ কর। ওদের সম্পর্কে কিছু জানলে বলো, অথবা আমার পথ আমিই খুঁজে নিই।
সবাইকে নিশ্চুপ দেখে রাফি নিজ পথে হাঁটতে শুরু করল? কিছুদূর যাওয়ার পর মহিলাটির গলা শোনা গেল,
-“তুমি ওদের ধরতে চাও, তবে নিজের ছায়া ধর।”
রাফি থমকে দাঁড়ালো। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার ছায়া একপাশে হেলে পড়ছে। রাফি গভীর দৃষ্টিতে নিজের ছায়ার দিকে তাকালো। কেন জানি মনে হলো, এই ছায়া জীবন্ত, এরও আছে আলাদা সত্তা।
কোনো জীবন্ত অস্তিত্ব। তারপর গলার নিচু স্বরে ছায়াটা বলে ওঠে-
“তুই এখন শুধু জানিস না, তোর ভেতরেও আমরাই আছি।”
হঠাৎ করেই চারপাশে সময় যেন স্থির হয়ে যায়। শব্দ, বাতাস- সব থেমে যায়। পিছন থেকে ঐ চারজনের হাসির শব্দ ভেসে আসে। সেই শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র থেকে আরও তীব্র হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় রাফি। মনে হয়, সে বুঝি বহুদিন ধরেই এই ছায়া প্রোগ্রামের অংশ। তার শৈশব, তার লেখা, তার ঘুম- সবকিছুতে যেন কেউ ছায়ার মতো অনুসরণ করছিল। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফ্ল্যাশব্যাক:
এক অচেনা ল্যাবে শিশু বয়সের রাফি মাথায় হেডগিয়ার পরে আছে, তার মস্তিষ্কে কিছু ইনপ্লান্ট করা হচ্ছে।
সে চিৎকার করে উঠে বসে পড়ে- ঘর, ছায়া, সব উধাও। সে এখন নিজের ফ্ল্যাটে, ভোর হয়েছে। (এরপর ১১ পৃষ্ঠায়)
তার ফোনে একটি মেসেজ: “Truth is heavier than death. Go to Hazaribagh sewer gate. Code: 19ÑXÑShadow.”
হাজারীবাগের একটি পুরনো নর্দমার গেটের ভেতরে প্রবেশ করে রাফি। অন্ধকার সুড়ঙ্গ, ছেঁড়া তার, ভেজা ইট আর পুরনো রক্তের গন্ধ। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর সামনে আসে একটি ধাতব দরজা। কোড বসানোর জায়গায় সে লেখে: `19ÑXÑShadow'
ভেতরে এক বিশাল আর্কাইভ রুম। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় রাফির- এখানে প্রতিটি তাকজুড়ে আছে মৃত ৫০৪ জনের ব্যক্তিগত নথি, ডায়েরি, এবং কিছু ভয়ানক রেকর্ডিং। একটি রেকর্ড চালু করে সে।
“আমি মেজর মাহবুব। যদি কেউ এই রেকর্ড শোনে, জানবেন, ছায়া মন্ত্রিসভা শুধু একটি সরকার নয়, এটি মানুষের একটি বিকল্প কাঠামো। অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব এবং মৃত গোয়েন্দাদের মস্তিষ্ক থেকে তৈরি এক অদৃশ্য কেন্দ্র। যা আমরা নির্মাণ করেছি তথ্য বিশ্লেষণের জন্য। কিন্তু এটা এখন হাতছাড়া হয়ে গেছে। এটি এত উন্নত হয়েছে যে, যা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। আর এটা এখন আমাদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।”
পাশে আরেকটি কক্ষ। রাফি প্রবেশ করে সেখানে। একটি ছোট বিছানায় পড়ে আছে এক মৃতপ্রায় বৃদ্ধ।
-তুমি এসেছ রাফি? কাঁপা গলায় বলল বৃদ্ধ।
-আপনি কে? আমাকে কীভাবে চেনেন?
-ওরা বলল তুমি আসছ।
-ওরা কারা?
-ছায়ারা?
-আপনি?
-আমি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা। সেই অভিশপ্ত গোপন প্রোজেক্টের প্রধান। আর এখন ছায়ার বন্দি।
-আমাকে বলুন, আমি জানতে চাই।
– “জানলে যে মৃত্যু আসে। ওরা সব নিয়ন্ত্রণ করে। চিন্তা, অনুভূতি সব। ওরা সব জানে, কারণ ওরা ছায়া, ছায়ারা সর্বত্রই বিরাজিত।
– “আপনি বেঁচে আছেন?”
– “কারণ আমি নিজেই ‘প্রটোকল সি’র শেষ কোড জানি। যা প্রজেক্টকে শেষ করতে পারে, তাই আমি এখনো জীবিত।”
– “তাহলে দিন আমাকে!”
– “দিতে পারি, তবে কাকে দিব? তুইও তার অংশ। তোরও সঙ্গে ছায়া আছে, ছায়া ছাড়া আসতে পার”?
রাফি দেখে লাইটের আলোয় একপাশে তার ছায়া পড়েছে। দেখে মনে হলো, সে ছায়া গভীরভাবে তাকে দেখছে, শুনছে।
বৃদ্ধ হাসলো, তারপর ফিসফিস করে বলল,
-“ছায়া ছাড়া আসতে পার? দেখ কীভাবে আঁড়ি পেতেছে। ওরা এটাই চায়, আমি কোড বলি আর ওরা নিজেদের অমরত্ব অর্জন করুক আর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিক। এ আমি হতে দিতে পারি না।”
-আলো থাকলে ছায়াতো হবেই, আলো নিভিয়ে দিই?
-বৃদ্ধ হাসলো, ওটাওতো বড় ছায়া?
রাফি উত্তেজিত হয়ে উঠল, ছায়া ছাড়া আদৌ সম্ভব?
-কেন নয়, আমাকে দেখ।
রাফি দেখল, বৃদ্ধের ছায়া নেই। লাইটের আলোয় বৃদ্ধের ছায়া পড়েনি। এমনকি ঘরের কোনো আসবাবেরও কোনো ছায়া নেই।
ছায়া থেকে নিজেকে কীভাবে মুক্ত করবে রাফি। সে চটপট করে, নিজেকে ছায়ারই অংশ মনে হয়? মনে হয় তার উপর, মন ও সিদ্ধান্তের উপর তার নিজেরই নিয়ন্ত্রণ নেই।
বৃদ্ধ বলে- “প্রতিটি ছায়া সদস্য বাস্তবে কেউ না কেউ, তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ছায়া কোড দেওয়া হয়। তবে তুই... তুই ‘ডিসরাপ্টর’। তোর সত্তা দ্বৈত- একদিকে ছায়া, একদিকে আলো।”
আমি তোকে ছায়ামুক্ত করে দিচ্ছি। বৃদ্ধ রাফির ছায়ার গলা বরাবর চেপে ধরে। রাফি অবাক হয়ে দেখে ছায়াটি চটপট করছে, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে সেটার। পর ক্ষণে উদাও। এখন রাফির কোনো ছায়া নেই।
বৃদ্ধ হোহো করে হাসে। ‘এভাবেই আমি সব ছায়া তাড়িয়েছি। তবে সময় নেই, বৃদ্ধ ফিসফিস করে কিছু বলে। কোডটি ভুলবে না, এটাই একমাত্র উপায় প্রজেক্টটি অকেজো করার। মনে রেখ, কোডটি হারালে সবকিছু ছায়াদের নিয়ন্ত্রণে যাবে।
বৃদ্ধ পথ দেখিয়ে দেয়।- “নিউট্রাল সার্ভার” ওই দিকে। যেখানে ছায়া প্রোগ্রাম চালানো হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে গোপন ডেটা সেন্টার। সুরক্ষ পথে রাফি দুই ঘণ্টা হাঁটে। ৬৫ ফুট গভীর। সার্ভারে ঢুকে পড়ে সে- ছদ্মবেশে। তার আইডেন্টিটি শনাক্ত হতেই চারপাশে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। “ALERT! DISRUPTOR IDENTIFIED.”
একটি ভার্চুয়াল ইন্টারফেসে ছায়া নিজের গলা শোনায়-
– “তুই পালাতে পারিস না, কারণ তুই তো আমি...”
– “তাহলে আমিও তো তোকে ধ্বংস করতে পারি।”
রাফি হাতে নেয় শেষ অস্ত্র- Protocol C Key
'Execute: SelfÑDebugging Death Loop'
সমস্ত সার্ভার কম্পন করতে শুরু করে। দেশের উপরে কালো মেঘ ঘনীভূত হয়। একদিকে ছায়া মন্ত্রিসভার কৃত্রিম মস্তিষ্ক- অন্যদিকে রাফির মানবিকতা, স্মৃতি, ঘৃণা, ভয়, সাহস সবকিছু একত্র হয়ে দাঁড়ায় সত্যের পক্ষে। তিন মিনিটের মাথায় একের পর এক সার্ভার বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ছায়ার শেষ গলা-
“তুই কী বুঝিস মৃত্যুর পরেও ছায়া থাকতে পারে?”
রাফি চোখ বন্ধ করে হাসে— “কিন্তু আলোও রয়ে যায়।”
সব অন্ধকারে ডুবে যায়। তারপর ভোর হয়। বহুদিন পর পত্রিকায় ছাপা হয়: “৫০৪ জন হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য: ছায়া মন্ত্রিসভা: একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।”
মোহাম্মদ রাফির নাম নেই লেখকের জায়গায়। কিন্তু যারা জানে, তারা জানে- ছায়া আর ফিরে আসেনি। কিন্তু আলো ঠিকই থেকে গেছে।
তিন.
ভোরের আলোয় ধোয়া ভিজে ঢাকায় শহরের মানুষ জানে না, তারা আরেকটা দিন জেগে উঠেছে এক অজানা অন্ধকার থেকে ফিরে। পত্রিকার শিরোনাম ঝড় তুলেছে। কিন্তু কেউ জানে না, সত্যিই কি সব শেষ?
চার মাস পর।
একটি পাহাড়ি শহরের নির্জন রিসোর্ট। এক বিদেশি সাংবাদিক সেখানে একা থাকছে- নাম র্যাচেল মায়ার। রাফির ঘটনার উপর ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে এসেছে। সন্ধ্যা বেলা, পাহাড়ের নিচে হালকা কুয়াশা জমেছে। র্যাচেল একা বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।
হঠাৎ, ফাইল খুলতে গিয়ে সে দেখে- একটি নামহীন ফোল্ডার।
[shadow-echo.exe]
সে অবাক হয়। “এইটা তো আমার ল্যাপটপে ছিল না...”
ডাবল ক্লিক করে। স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। এরপর ভেসে ওঠে একটি ঝাপসা মুখ- এক ছায়ার, এবং কণ্ঠস্বর-
“তুমি জানো না, তুমি দেখতে এসেছো, কিন্তু এখন তুমি দেখতে পারছো...”
ল্যাপটপ নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরের বাতি নিভে যায়। জানালার বাইরে ঝড় শুরু হয়। দরজার নিচ দিয়ে কালো ধোঁয়া গড়িয়ে আসতে থাকে।
র্যাচেল আতঙ্কে দরজার দিকে দৌড় দেয়, কিন্তু দরজা খুলে না।
হঠাৎ, পেছন থেকে শোনা যায় এক চেনা কণ্ঠ-
“আমরা তো বলেছিলাম... মৃত্যু ছায়া নয়, ছায়া মৃত্যুরও পরে থাকে।”
র্যাচেল ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায়।
তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মোহাম্মদ ওাফি।
কিন্তু তার চোখ এখন সম্পূর্ণ কালো।
সে আর মানুষ নয়।
তার ছায়া- আলোর উল্টোপথে এখন সত্য হয়ে উঠেছে।
“আমিই ছিলাম প্রটোকল সি। আমাকে মুক্ত করে... ওরা আরেক রূপে ফিরে এসেছে।”
র্যাচেল চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না।
স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা লাইন-
'The light didnÕ: win. It only made the shadow deeper.'
ঘরের সব কাচ ফেটে যায়। চারপাশে শুধু ছায়া...
এবং তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে-
একটা আধা-মানব, আধা-প্রোগ্রাম রূপ।
নতুন ছায়া প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে।
Version: SHADOW CABINET 2.0
Status: ACTIVE
Target: Unknown.
Location: Everywhere.
শেষ নয়। এটা তো শুরু ছিল মাত্র।
ছায়ারা কখনো শেষ হয় না- তারা কেবল রূপ বদলায়।
প্যানেল