ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

শিল্পের ব্যক্তিত্ব

অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৮:১৮, ৩ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৮:২৩, ৩ জুলাই ২০২৫

শিল্পের ব্যক্তিত্ব

শিল্প কী? আর্ট কাকে বলে? না, এটি আজকের প্রশ্ন নয়। তাহলে শিল্প কি কেবল রঙের খেলা, সুরের ছোঁয়া, কিংবা শব্দের বিন্যাস? নাকি শিল্প নিজেই এক ধরনের ব্যক্তিত্ব? আজকের আলোচনা এই ব্যক্তিত্ব নিয়ে। শিল্পের ব্যক্তিত্ব। আর্টের কি কোন পার্সোনালিটি আছে? শিল্পের কি কোন ব্যক্তিত্ব আছে? থাকলে সেটা কী? 
এই প্রশ্ন আমার মাথায় প্রথম আসে এক বিকেলে। ছুটির বিকেলে। সামারের এক বিকেলে লন্ডনের এক ছোট আর্ট গ্যালারিতে। এক অচেনা শিল্পীর ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমি যেন কারও চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ক্যানভাসটি নীরব ছিল, কিন্তু তার নীরবতা ছিল উচ্চকিত। যেন কেবল দেখার নয়, শোনার মতোও কিছু ছিল ওটায়। ছবিটি যেন আমার সাথে কথা বলছিল। আমরা অনেক সময় ভাবি, আর্টকে বুঝতে হলে, শিল্পকে চিনতে হলে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি- শিল্প বোঝার জন্য দরকার হৃদয়। আর্ট বুঝতে হলে তার দিকে হার্ট দিয়ে তাকাতে হয়। অনেকটা ভালোবাসা বোঝার মতো। ভালোবাসা যেমন চোখের ভাষায় বলে ওঠে, শিল্পও তেমনি এক নিঃশব্দ ভাষায় কথা বলে। আমরা যদি মন খুলে শুনি, শিল্পও তখন নিজের গল্প বলে।

শিল্প ও ব্যক্তিত্ব
ব্যক্তিত্ব একেকজনকে আলাদা করে তোলে। একজন থেকে আরেকজনকে পৃথক করে। কারও মধ্যে থাকে এক গভীর নিঃসঙ্গতা, কারও মধ্যে ওঠে চঞ্চলতার ঝড়। এই বৈচিত্র্যই শিল্প-রুচিকে গঠন করে। আমাদেরকে আমাদের অজান্তে তৈরি করে। আমরা যেভাবে শিল্পকে বুঝি, গ্রহণ করি কিংবা প্রত্যাখ্যান করি, তার মধ্যে প্রতিফলিত হয় আমাদের মনের গঠন। যিনি নিঃশব্দ ভালোবাসেন, হয়তো বিমূর্ত চিত্রকলার প্রতি আকৃষ্ট হন। যেখানে রং আছে, রেখা আছে, অথচ নেই কোনো ব্যাখ্যার গ্যাঁড়াকল। আর যিনি যুক্তিবাদী, হয়তো তিনি পছন্দ করেন স্থাপত্যের জ্যামিতিক শৃঙ্খলা, বা সংগীতের গাণিতিক বিন্যাস। আবেগপ্রবণ একজন মানুষ হয়তো ডুবে যান নাটকের নাটকীয়তায়, একটি চরিত্রের কান্নায়, অথবা একটি সুরের মৃদু কাঁপনেও। 
আমরা যেমন বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে চিনে নিই যার যার প্রিয় লেখককে, তেমনি শিল্প আমাদের ভেতরের চেনা-অচেনা মানচিত্রকে উল্টে ধরে। আপনি যে শিল্পে আকৃষ্ট হন, তা-ই বলে দেয় আপনি আসলে কেমন মানুষ। 

শিল্পের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব
আর্ট একা নয়। শিল্প কখনোই একা থাকে না। প্রত্যেক শিল্পকর্মের মধ্যে থাকে একজন শিল্পীর ছায়া, একজন দর্শকের প্রতিফলন, আর আমাদের ভিতরের অজানা রুচির গভীর নিঃশ্বাস।
একটি চিত্রকর্মকে আপনি যেমন দেখেন, আমি হয়তো তা-ই দেখি অন্যভাবে। আমার দেখার চোখ আর আপনার অনুভব আলাদা। এটাই শিল্পের বিস্ময়, আর্টের জাদু। শিল্প একটি দর্পণ। এই আয়না আপনার ভেতরের নিজস্ব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, অথচ একই সঙ্গে অন্যের প্রতিচ্ছবিও রেখে দেয় তার গায়ে।
শিল্প যদি মানুষ হতো, তবে সে হতো এক ধীর, সংবেদনশীল শ্রোতা। কথা কম বলত, কিন্তু গভীরভাবে শুনত। 

মনস্তত্ত্ব ও শিল্প-রুচির রহস্য
মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের ব্যক্তিত্ব কাঠামো, যেমন introversion, openness to experience, neuroticism প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে তার শিল্প-রুচিতে। যারা উন্মুক্ত মানসিকতাসম্পন্ন (openness to experience), তারা সাধারণত বিমূর্ততা, পরীক্ষামূলক শিল্প এবং আধুনিক শৈলী পছন্দ করেন। অন্যদিকে যারা সচেতন ও নিয়মনিষ্ঠ (conscientious), তারা পরিচিত রীতিনীতিকে বেশি পছন্দ করেন। অনুভূতির ভারে যারা নতজানু, তারা সহজেই নাটক, গান কিংবা কাব্যের গভীরে হারিয়ে যান। 
আমরা আসলে সবাই একেকটি গল্প। আমাদের যার যার জীবনটাই একটি অসম্পূর্ণ গল্প। আমাদের শিল্প-রুচি সেই গল্পের একটি ভূমিকার মতো। আপনি কী ভালোবাসেন- নীরবতা না শব্দ, ছায়া না আলো, জ্যামিতি না প্রবাহ, এই প্রতিটি পছন্দের মধ্যেই আপনি আছেন।
শিল্প এক ধরনের এক্স-রে। আমাদের ভেতরের এক্স-রে। আপনার বাহ্যিক আচরণ যতই আলাদা হোক না কেন, আপনার শিল্প-রুচির মধ্য দিয়ে দেখা যায় আপনার ভিতরের মানুষটিকে। 

আমি ও আমার শিল্পচেতনা
আমি যখন একটি চিত্র দেখি, তখন আমি শুধু চোখ দিয়ে দেখি না, আমি শ্বাস নিয়ে দেখি। আমার অস্তিত্বের কোষ দিয়ে দেখি। শিল্প দেখার মধ্যে একটা ধ্যান থাকে। এটা অনেকটা ঘুমের মতো। আপনি চোখ বন্ধ করলে সামনের দেখার জগৎ বন্ধ হয়ে গেলেও কিন্তু অন্য একটা জগৎ খুলে যায়। মনের সে জগতে আপনি তখন আরেকটা জগৎ দেখতে পান। 
একবার লন্ডনের টেট মডার্ন-এ গিয়ে রথকোর এক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম মিনিট দশেক। চারপাশে অনেকে এসেছিল, কেউ ছবি তুলে চলে গেছে, কেউ বসে বিশ্রাম নিয়েছে। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। স্থির একটি তারার মতো দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, ছবিটা আমাকে কিছু বলছে না, বরং আমাকে শুনছে। 
শিল্প অনেক সময় শ্রোতা হয়ে ওঠে। আমরা যত ভাবি শিল্প বলতে বোঝায় কথা বলার মাধ্যম, শিল্প আসলে অনেক সময় নীরব শ্রবণ। শিল্প দেখে আপনি যা বলেন না, সেটাও সে বুঝে ফেলে। 

শিল্প ও আত্মপরিচয়
আপনি কোন কবিকে ভালোবাসেন? কোন গান আপনাকে কাঁদায়? কোন ছবি আপনাকে থমকে দাঁড় করায়? এই প্রতিটি প্রশ্নই একইসঙ্গে এক আত্মজিজ্ঞাসা। আপনি যেসব শিল্পকর্মে বারবার ফিরে যান, সেগুলো আপনার এক নিঃশব্দ আত্মজীবনী। 
আমি রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসি, আমি বার্ট্রান্ড রাসেলকে ভালোবাসি। তাদের সৃষ্টিকর্ম ভালোবাসি, তাদের লেখা ভালোবাসি, তাদের ব্যক্তিত্ব ভালোবাসি। আমি রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসি, রেইগে ভালোবাসি, বব মার্লের গান ভালোবাসি। শুধু তাদের সুরের জন্য নয়, তাদের নীরবতার জন্যও ভালোবাসি। তারা যা বলেননি, তাতেই যেন বেশি কিছু বলেছেন। সাকসোফোন, বাঁশি কিংবা কান্ট্রি সং এর সুরে শুনতে পেয়েছি যা তারা বাজায়নি। আবার কোনোদিন একটি জাপানি হাইকু পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছি। যেখানে তিন লাইনের মধ্যে পুরো একটি জীবন থাকে। 
শিল্প কখনো ব্যাখ্যা নয়, অনুভব। এবং এই অনুভবের পথেই গড়ে ওঠে আত্মপরিচয় আর শিল্পের ব্যক্তিত্ব। 
শিল্প মানেই সম্পর্ক
শিল্প কেবল সৃষ্টি নয়, শিল্প এক সম্পর্ক। এই সম্পর্ক শিল্পীর সঙ্গে, দর্শকের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে। আপনি যখন একটি কবিতা পড়েন, আপনি শুধু লেখককে জানেন না, আপনি নিজেকেও চিনতে শুরু করেন। আপনার অশ্রু, আপনার হাসি, আপনার থমকে যাওয়া, সব মিলিয়ে আপনি আর শিল্প একসঙ্গে একটা মুহূর্ত তৈরি করেন। 
একবার এক বন্ধুর সঙ্গে কফিশপে কফি পান করছিলাম। বললাম ‘শিল্প মানে আসলে সংবেদনশীলতার এক পরম আদান-প্রদান।’ সে হেসে বলল, ‘তুমি আবার এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ।’ আমি হেসেছিলাম, কিন্তু মনে মনে বলেছিলাম- যে মানুষ কখনো শিল্পে কেঁদে ওঠেনি, সে জীবনকে এখনো পুরোপুরি ছুঁতে পারেনি। আর্ট হাসায়, আর্ট কাঁদায়, আর্ট আপনাকে ভাঙে, আর্ট আবার আপনাকেই গড়ে। 

শিল্প, সময় ও সমাজ
শিল্প সময়ের সন্তান। আর্ট একটি নির্দিষ্ট সমাজ, সংস্কৃতি ও মনোভাবের প্রকাশ। তাই শিল্পের চরিত্রে যেমন একজন ব্যক্তির ছাপ থাকে, তেমনি একটি যুগেরও ছায়া পড়ে। 
পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ শুধু একটি ছবি নয়, একটি সময়ের প্রতিবাদ। ভ্যান গঘের সূর্যমুখী কেবল ফুল নয়, একটি একাকিত্বের জ্বলন্ত প্রার্থনা। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনের পরাজয়ে নয়, মৃত্যুরও মাঝে জয়’ শুধু গান নয়, এক গভীর বেঁচে থাকার আশ্বাস রয়। 
এইসব শিল্পকর্ম আমাদের বলে- আমরা মানুষ, আমরা অনুভব করি, আমরা প্রতিবাদ করি, আমরা ভালোবাসি। 
শিল্পের ছায়ায় ব্যক্তি
শেষ পর্যন্ত মনে হয় শিল্প আর ব্যক্তি আলাদা কিছু নয়। আমরা যেমন শিল্প দেখি, তেমনি শিল্পও আমাদের দেখে। আমরা শিল্পের দিকে তাকিয়ে বলি ‘এটা আমার মতো।’ অথচ শিল্প বলে ‘তুমিই আমি।’ 
শিল্প এক ধরনের নীরব আত্মজীবনী। আপনার-আমার আত্মজীবনী। তার ভাষা প্রতিধ্বনির মতো। যতটা আপনি শুনবেন, ততটাই সে বলবে। আপনার শিল্প-প্রীতি, আপনার শিল্প-ভয়, আপনার শিল্প-সম্মোহন, সবই আপনার অন্তর্জগতের অদৃশ্য স্বাক্ষর। 
তাই শিল্প মানেই জীবন। শিল্প মানেই আপনি। 

প্যানেল

×