
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও জর্জ ডব্লিউ বুশ মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড (USAID) বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘মর্মান্তিক ভুল’ ও ‘ট্র্যাজেডি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সোমবার সংস্থাটির কর্মীদের জন্য আয়োজিত এক বিদায়ী ভিডিও বার্তায় তাঁরা এই মন্তব্য করেন। একইসঙ্গে, এক গবেষণা প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে—এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের অতিরিক্ত মৃত্যু হতে পারে।
সংস্থা বন্ধের সিদ্ধান্ত
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও মার্চ মাসে ঘোষণা দেন, ইউএসএইড-এর ৮৩ শতাংশ কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে এবং সংস্থাটিকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একীভূত করে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ গঠন করা হচ্ছে। সোমবার ছিল ইউএসএইড-এর স্বাধীনভাবে পরিচালিত শেষ দিন।
গবেষণার ভয়াবহ পূর্বাভাস
ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে হঠাৎ করে ইউএসএইড-এর তহবিল বন্ধ করার ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৪ মিলিয়ন (১ কোটি ৪০ লাখ) অতিরিক্ত মৃত্যু হতে পারে, যার এক-তৃতীয়াংশ হবে শিশুদের মধ্যে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গত দুই দশকে ইউএসএইড-এর সহায়তায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৯১ মিলিয়নেরও বেশি মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে। এই সহায়তা স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, শিক্ষা, মানবিক সহায়তা এবং উন্নয়ন খাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্টদের প্রতিক্রিয়া
ভিডিও বার্তায় বারাক ওবামা বলেন,
“ইউএসএইড ধ্বংস করা একটি ভয়াবহ ভুল। এটি শুধু জীবন রক্ষা করত না, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক অংশীদার গড়ে তুলত। আপনি যা করেছেন তা বহু প্রজন্ম ধরে মনে রাখা হবে।”
জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেন,
“PEPFAR কর্মসূচির মাধ্যমে ২৫ মিলিয়ন মানুষের জীবন রক্ষা করা হয়েছে। এই উদ্যোগ আমাদের জাতীয় স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইউএসএইড কর্মীরা আমেরিকার প্রকৃত শক্তি দেখিয়েছেন—তা হলো সহানুভূতিশীল হৃদয়।”
মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
গবেষণার সহলেখক এবং মোজাম্বিকের মানহিসা স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ফ্রান্সিসকো সাউটে বলেন,
“এই তহবিল বন্ধের ফলে শুধু জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে না, বরং সেই স্বাস্থ্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে, যা গড়ে তুলতে দশকের পর দশক সময় লেগেছে।”
ISGlobal-এর গবেষক দাভিদে রাসেল্লা বলেন,
“এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এসেছে যখন জাতিসংঘের উন্নয়ন অর্থায়ন বিষয়ক সম্মেলন সেভিয়ায় চলছে। যদি আমরা এসডিজি অর্জন করতে চাই, তাহলে ইউএসএইড-এর মতো প্রতিষ্ঠিত জীবনরক্ষাকারী তহবিল বন্ধ নয়, বরং আরও বিস্তৃত করা উচিত।”
অন্যান্য বক্তাদের প্রতিক্রিয়া
ভিডিও বার্তায় অংশ নিয়েছেন গায়ক বোনো, যিনি বলেন:
“তারা তোমাদের ডাকলো চোর/ অথচ তোমরাই ছিলে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব।”
সাবেক লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ, সাবেক কলম্বিয়ান প্রেসিডেন্ট হুয়ান মানুয়েল সান্তোস এবং জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড-ও সংস্থাটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
সংক্ষিপ্ত পটভূমি
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি-র উদ্যোগে ৬০ বছর আগে ইউএসএইড প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বব্যাপী মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তায় সবচেয়ে বড় সরকারি দাতা সংস্থা হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০২৩ সালে বিশ্ব মানবিক ব্যবস্থায় সরকারি তহবিলের মধ্যে ৪৩ শতাংশই এসেছিল ইউএসএইড-এর পক্ষ থেকে।
সমালোচনার মুখে ট্রাম্প প্রশাসন
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএইড-কে “র্যাডিক্যাল লেফট লুনাটিকদের দ্বারা পরিচালিত” ও “ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত” বলে অভিহিত করেছিলেন। টেসলা প্রধান ইলন মাস্ক এটিকে “একটি অপরাধী সংস্থা” বলেও মন্তব্য করেন।
সংস্থাটির আকস্মিক বন্ধ ঘোষণা এবং চলমান প্রকল্পগুলো এক মাসের মধ্যে থামিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা বিশ্বজুড়ে মানবিক কার্যক্রমে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। গবেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত একটি ‘চেতনাপ্রসূত নীতিগত ভুল’, যার প্রভাব হবে একটি বৈশ্বিক মহামারি বা সশস্ত্র সংঘর্ষের মতোই ভয়াবহ।
Jahan