ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

ছোট গল্প

সময় যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন হারিয়ে যায় আকাশ

ওয়াজেদ হোসেন জীম

প্রকাশিত: ২০:৫১, ৩ জুলাই ২০২৫

সময় যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন হারিয়ে যায় আকাশ

ছবিতে নীল পাঞ্জাবি পরিহিত লেখক :ওয়াজেদ হোসেন জিম, ডান পাশে শার্ট পরিহিত মৃত: নাফিস শাহরিয়ার আকাশ

সকল অধ্যায়ের সমাপ্তি,
ছোট অক্ষরে ব্যয়িত কবিতার মর্মার্থ,
বাইরের বাতাসের মৃদুমন্দ ছোঁয়া,
সকল চিন্তাধারাকে উর্ধ্বে তুলে নেয়াকে 
জীবনের চেয়ে বেশি অর্থবহ মনে হওয়া,
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবার ক্ষমতা।
(মৃত্যু‌ ক্ষুধা: যাররাফ রহমান রাশহা) 

আকাশ, নাফিস শাহারিয়ার আকাশ। আমার বাল্যকালের বন্ধু, আমার সহপাঠী, আমার প্রতিবেশী (সাময়িক)। স্মৃতির প্রতারণায় সঠিকভাবে বলতে পারছি না, আকাশের সাথে আমার পরিচয় কখন! সম্ভাব্য চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন। আকাশের বাড়ি ব্রীজরোডের অ্যাকোরেস্টেড পাড়ায় হলেও কয়েকবছর ও লেখাপড়া করেছে পলাশপাড়ায় ওর এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে। সেই সময়ে মাঝে মধ্যে একসাথে খেলাধুলা করতাম‌। ব্যাট, বল হাতে মাঠে গিয়ে আকাশকে ডাক দিতাম। মাঠের পাশেই ওর বাসা হবার কারণে বেরিয়ে আসতো এক ডাকেই। সহপাঠী সকলের সাথে আমার বন্ধুত্ব থাকলেও কয়েকজন ছিলো যারা বন্ধুত্বের থেকেও প্রিয় ছিলো। এদের মাঝে - রাসেল, পলক, আশিক, রাজ ছিলো অন্যতম। রাসেল মাঝে মাঝে আকাশের বাসায় যেতো, ওর সাথে আমিও যেতাম। আড্ডা হতো, গল্প হতো। 

আকাশের সাইকেল ছিলো। ওর নতুন সাইকেল কেনার পর কয়েকদিন ওর সাথে স্কুলে যাতায়াত করতাম। কিন্তু মা সাইকেল ভয় পেতেন, তাই কিনেও দেননি আবার তার সামনে অন্য কারোও সাইকেলেও উঠতে দিতে চাইতেন না। তাই খুব বেশিদিন ওর সাথে যাতায়াত করা হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন রিকশা রিকশা না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম পেছনে থেকে সাইকেল নিয়ে এসে ব্রেক চেপে সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ বলতো - উঠ...

কখনও কখনও বাড়িতে ফাঁকি দিয়ে রাসেল, আমি, আকাশসহ আরোও কেউ কেউ সাইকেল নিয়ে বেড়াতে যেতাম শহরের আশেপাশেই। বেশ চমৎকার, আনন্দেই তখন দিন চলে যাচ্ছিল। 

সপ্তম শ্রেণীতে পড়া শেষে নতুন বছরের শুরুতেই আবাসিক স্কুলে ভর্তি হই। জীবনের প্রবাহ, গতিপথ বদলে যায়। বছরে নির্দিষ্ট কয়েকবার ছুটিতে যেতাম। আত্মীয়-স্বজন করতেই ছুটি শেষ হয়ে যেতো, তাই পুরাতন বন্ধুত্বের সাথে খুব বেশি সময় হতো না - আড্ডা দেবার। ঈদে, পুজায় বাড়িতে গেলে মাঝে মাঝে রাস্তায় অথবা পাড়ায় আকাশের সাথে দেখা হতো, দুইএকমিনিট দাঁড়িয়ে হতো আলাপচারিতা। তারপর দুজন দুদিকে। হাঁটার গতি বাড়ে, দুরত্ব বাড়ে। পিছন ফিরে কখনও দেখা হয়নি সময়ের সাথে কতটা দুরত্ব বেড়ে গেছে। 

বছরের পর  বছর এভাবেই দৃষ্টি সীমার দুরত্বে টিকে থাকে আমাদের বন্ধুত্ব। গত কয়েকবছর হলো রোযায় ঈদে বাড়ি গেলে কোন না কোন বন্ধু কল দিয়ে বলতো, আহম্মদ উদ্দিনের আমাদের ব্যাচের সবাই একটা ইফতার পার্টির আয়োজন করেছি ওমুক তারিখ, ওমুক জায়গা। আসিস। এই ইফতার অনুষ্ঠানে গেলে আহম্মদ উদ্দিনের অনেকের সাথেই দেখা হতো। সেই ইফতারে আকাশের সাথেও দেখা হতো, কথা হতো। ইফতারের আগে নানা স্মতিতে, হাসিঠাট্টায়, রঙ্গিন নানা আলোচনায় আমাদের ইফতার হলেও সেদিনের রোযা চলে যেতো খরচার খাতায়। বিদায় বেলায় সকলেই চাইতো, আগামী বছর দ্রুত আসুক। 

এই বছরেও ইফতার অনুষ্ঠানের একদিন আগে, আকাশের সাথে পার্কে দেখা। সেখানে রাহি, উদ্দ্যোগ আর বর্ণও ছিলো। ইফতারের জন্য ডাকলো। কিন্তু এইবার আমার ছুটি কম ছিলো। যেদিন ইফতারের আয়োজন ছিলো স্কুলের সবাইকে নিয়ে সেদিন আমাদের বাসায় ছোট একটা অনুষ্ঠান ছিলো। তাই এইবার অংশগ্রহণ করতে পারিনি। পারিনি বন্ধুদের সাথে আড্ডাময় সময় উপভোগ করতে। 

ঈদের পর পর চলে আসি। আবার যাই কুরবানী ঈদে। এই ঈদের পর ২০ তারিখ (২০ জুলাই ২০২৪) রিতুর বিয়ের অনুষ্ঠানে আকাশের সাথে দেখা। রিতুর বিয়ের স্মৃতিগুলো ধরতে রাখতে সহযোগিতা করছিলো আকাশের ফটোগ্রাফী টিমের সদস্যরা। আমি পরিবারসহ গিয়ে ছিলাম - পরিবার বলতে সহধর্মিণী আর মেয়ে। আমাদের দেখে আকাশ এগিয়ে আসলো। কুশলাদি শেষে আমি সহধর্মিণী মিম আর মেয়ে ইলহামের সাথে পরিচয় করায় দিলাম। ওদের বসতে বলে আমরা দুজনে‌ একটু সাইডে গেলাম নিজেদের মতো আলাপ করতে। সাইডে যেতেই আকাশ বললো - তোদের তো প্রেম করে বিয়ে? কত দিন প্রেম করেছিস? ঘটনা বল? 

আমি হালকা কিছু বললাম। আমিও কিছু প্রশ্ন করলাম। আকাশ উওর দিলো। আকাশ কথা বলে থেমে থেমে। যখন কথা শোনে তখন একদম চুপ হয়ে যায়‌। কথার মাঝে তিশার আম্মু এসে বললো - 'চলো খাইতে বসবো।' আকাশকে বললাম - চল, একসাথে খাওয়া-দাওয়া করি। সে বললো - আরে এখন না। আমার টিমের কেউ এখনও খায়নি। আমি খাই কি করে? আকাশের দায়িত্ববোধের এই জবাবের পর আর কোন কিছু বলার থাকে না। 

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই তিশা কল দিয়ে ছাদে ডাকলো। ফটোশুটের জন্য ওরা ছাদে গেছে। ছাদে গিয়ে আমরা সকলেই ছবি তুললাম। আকাশ নিজেই আমাদের ছবি তুললো। ছবি তোলা শেষে যখন নেমে আসবো ঠিক তখন, তিশার ভাই তানভীর বললো - ভাইয়া আপনারা দুজনে দাঁড়ান আমি ছবি তুলি আপনাদের। আপনাদের দুই বন্ধুর তো ছবি তোলা হলো না। আমরা দাঁড়ালে তানভীর ছবি উঠালো। আমার মোবাইল তানভীরকে দিয়ে বললাম - এইটা দিয়েও উঠাও। আমাদের বন্ধুত্ব দেড় যুগের সমান কিন্তু আমাদের দুজনের কোন ছবি নেই। এটাই হবে আমাদের দুজনের প্রথম ছবি। আকাশ বললো - হ্যা রে, সত্যিই তো আমাদের দুইজনের কোন সিঙ্গেল ছবি তোলা নেই।

নিচে নেমে ইলহামকে কোলে নেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু ইলহাম পরিচিত ছাড়া খুব কম মানুষের কোলে যায়। তাই আকাশের কোলেও গেলো না। চলে আসার আগে আকাশকে বললাম - ২০২৬ সালে আমাদের প্রেমের একযুগ হবে। আর্থিক উন্নতি হলে একটা অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করবো। তখন ছবি, ভিডিও সব তোর দায়িত্বে থাকবে। ঠিকঠাক সব করে দিবি। আমার কথায় হাসতে হাসতে আকাশ বললো - ঠিক আছে। তোর জন্য আমি সেই ইভেন্টটা ফ্রী করে দিবো।

আর ক’টা দিন থাকলে হতো।
চড়ুইভাতি’র সময় শেষ,
দোতারা যায় আকাশপানে, 
সেই যেখানে গানের দেশ…
সবাই আগুন পেরিয়ে এলাম। 
সবাই তোমার গানের লোক।
গান ফিরেছে মাটির কাছে। 
মৃত্যু কেবল মিথ্যে হোক।
(মৃত্যু কেবল মিথ্যে হোক : শ্রী জাত)

রাত এগারোটায় (২ জুলাই ২০২৪) হাসান ভাইকে একটা কাজে কল দিলাম। ভাই বললো, গাইবান্ধায় বড় একটা সড়ক দূর্ঘটনা ঘটেছে তুলসীঘাটে। বেশ কয়েকজন মারা গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু না। প্রতিদিন, প্রতিঘন্টা, প্রতিমিনিটে কোথায় না কোথায় কেউ না কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। হয়তো দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সড়ক দুর্ঘটনা ওতপ্রোতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যত বেশি উন্নয়ন ততবেশি সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু আইন প্রয়োগ হবে না, কোন বিচার হবে না। বরং দূর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে যদি বুলডোজার চালিয়েছে মারা যেতো তবেই হয়তো ভালো হয়। ড্রাইভাররা হত্যার পর শান্তিতে ঘুমাতে পারতো, সরকারকেও ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা দিতে হতো না। নিত্য এই ঘটনাকে যত এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। 

হাসান ভাইয়ের সাথে কথা শেষে ম্যাসেঞ্জারে বিশেষ কারণে নিশুকে ম্যাসেজ দিলাম। কথা শুরুর আগেই নিশু বললো - রাহি আকাশকে চেনো তো! আমাদের ব্যাচের। ওরা মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট করছে। ওদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জানো এ নিয়ে কিছু?
আমি বললাম - তুলসীঘাটে যে এক্সিডেন্ট হয়েছে তুমি কি তার কথা বলছো? 
উওর আসলো, হ্যা ওখানেই। ওদের মোটর সাইকেল পাওয়া গেছে। ওদের পাওয়া যায়নি এখনো। তুমি যাও খোঁজ করো ওদের। 

একটু আগেই যা আমার কাছে নিছক একটি সংবাদ ছিলো, তা আকস্মিক আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো। তুলসীঘাটে থাকা বিমল সরকার সাহিত্য সম্ভার ও পাঠাগারের শামীম ভাই ও কনককে কল করে অনুরোধ করলাম তারা যেনো দূর্ঘটনার স্থানে গিয়ে আমায় পরিস্থিতি জানায়। এছাড়াও সম্ভাব্য যারা যারা আকাশ আর রাহির খোঁজে গাইবান্ধা থেকে তুলসীঘাট যেতে পারে তাদেরকেও কল দিলাম, প্রায় সকলকেই কলে ব্যস্ত দেখাচ্ছিলো আবার কেউ কেউ ধরছিলো না। উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছিলো। যাদের নাম্বার নেই তাদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম নিউজটা মিথ্যে হোক। 

হৃদয়কে (সাংবাদিক) কল দিয়ে জানতে চাইলাম ঘটনার সত্যতা। সে তেমন কিছু বলতে পারলো না। আমি টানা কল করে যাচ্ছি যাদের সাথে যোগাযোগ করলে সত্যতা জানা যাবে। এক পর্যায়ে জীম (অ্যাপেক্স ক্লাবের) কল ধরে বললো - আকাশকে এখনও পাওয়া যায় নি! রাহিকে পাওয়া গেছে তবে শারীরিক অবস্থা খুব ভালো না। রংপুরে নেয়া হচ্ছে। আকাশকে আমরা খুঁজতেছি। 

একটু পরেই শামীম ভাই একটা ভিডিও দিলো। ঠিক তখনি কনক কল দিয়ে বললো, আপনার একজন বন্ধুকে পাওয়া যায়নি এখনো। ধারণা করা হচ্ছে, বাসের নিচে থাকতে পারে। জোরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি। 

শামীম ভাইয়ের ভিডিওটা দেখলাম। জীবন কতটা নির্মম হতে পারে, সেই জীবনের মূল্য ঠিক কত - ভিডিওটি হয়তো তারই প্রতিনিধিত্ব করে। আমার বুঝতে বাকি রইলো না - সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের জীবন কতটা ঠুনকো। জীবন-মৃত্যু সব মিশে একাকার হয়ে গেছে। 

বারোটা সতেরো মিনিট। হৃদয় কল দিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল - আকাশ মারা গেছে। 
- কে বললো? রিদিম কল করেছিলো। 

হৃদয়ের কল কেটে তাৎক্ষণিকভাবে রিদিমকে কল দিলাম। 
-রিদিম, আকাশ কেমন আছে? 
কিছু সময় চুপ থেকে রিদিম বললো - বন্ধু আকাশ তো এক্সপায়ার করছে। 

রিদিমের কল কেটে রিয়াদকে কল দিলাম। রিয়াদের ফোন ওয়েটিং দেখাচ্ছে বার বার। আমি না থেমে কল দিয়েই যাচ্ছি। এক পর্যায়ে রিয়াদ কল ধরলো। 
- রিয়াদ, আকাশ কোথায়?
- বডি গাইবান্ধায় সদর হাসপাতালের মর্গে আনছে। 
- তুই কোথায়? 
- আমি এখানেই আছি। মর্গের সামনে।
- কনফার্ম হয়েছে যে ওটাই আকাশ?
- হ্যা। 

কথা বলার মতো পরিস্থিতি আর থাকলো না। কল কেটে দিলাম। স্মৃতি কিছু সময় সময় প্রতারণা করে, কিছু সময় করে মশকরা, অট্টহাসি হাসি। ঝাঁপসা চেখে ভেসে উঠতে থাকে, আকাশের সাথে কাটানোর সকল মূহুর্ত। কি জীবন্ত প্রতিবিম্ব। সেই সকল মধুর পুরাতন স্মৃতি, যা আজকেই ধূসর হলো। 

মিনিট দুয়েকের মাঝে আমার ফেসবুক ওয়াল ছেয়ে গেলো একের পর এক পোষ্টে। আকাশের বিদায়... কত আহাজারি, কত স্মৃতি, কত মায়া, কত আবেগ অনুভূতি নিয়ে সেইসব লেখা! 

সড়ক দুর্ঘটনার পর আকাশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই খোঁজাখুঁজি করছিলো আকাশকে। অবশেষে আকাশকে খুঁজে পাওয়া গেলো ঠিকই কিন্তু আকাশ হারিয়ে গেলো, আকাশ হারিয়ে গেছে।

সকলেই নিজ নিজ পোস্টে আকাশকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আমিও পোস্ট দিয়ে গেলাম আকাশের প্রোফাইলে। ছয়ঘন্টা আগে স্টোরি দিয়েছে। আবাহ সংগীত শুনেই সব ঝাপসা হয়ে গেলো। আকাশ কি জানতো এই সব কিছু আর কখনও তার দেখা‌ হবে না। যে দৃশ্য আমাদের কাছে নিতান্তই সাধারণ, সেই দৃশ্যকে কি চমৎকার করে দেখিয়েছে আকাশ ওর ক্যামেরায়। বেশিক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারলাম না। আবেগকে কত সময় বেঁধে রাখা যায়?

এখন আষাঢ় মাস। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ে দিনব্যাপী। কখনওবা জোরে। আকাশের বৃষ্টি পছন্দ ছিলো না কিনা, কখনও জানা হয়নি। জানি না , আকাশ কখনও এমন চেয়েছিলো কি না যে, আকাশ শুয়ে থাকবে, বুকের ওপর ঝির ঝির কিংবা জোরে বৃষ্টি পড়বে।

আমরা ভাবি, জীবন পরিহাস করে। পরিহাস করে বলেই জীবন নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর। কিন্তু আসল কথা হলো, জীবন চলে সময়ের টানে। সময়ের হুকুমের জীবন। সময় যা চায়, তাই হয়! শুধু মিনিট পাঁচেক এদিক-ওদিক হলেই আকাশ হারিয়ে যেতো না। এইটা আমরা না বুঝলেও, আকাশ হয়তো বুঝে গিয়েছিলো তাই সর্বশেষ স্টোরিতে দিয়েছিলো - 

যেন সব মিশে গেছে বয়সের কবরে
প্রিয় প্রেমের মৃত্যু মরুর বালুচরে
মুখ ফিরিয়ে নেয় আমার সময়।
(আদিম ইচ্ছেরা : জাহিদুল বাপ্পা)

দিন যাবে, সপ্তাহ যাবে, মাস তারপর বছর। সময় বাড়বে, কোথায় নদী শুকিয়ে যাবে, কোথাও নদী জেগে উঠবে। কদম গাছে ফুল আসবে যথা সময়েই। বাতাস বইবে, শীত আসবে। কিন্তু আকাশ নেই। আকাশকে ধীরে ধীরে সকলকেই ভুলে যাবে। নিয়মের খেলা। হঠাৎ বছরে একবার করে মনে জেগে উঠবে আকাশের কথা। হা-হুতাশ, বিষণ্নতা ছাড়া তখন কিছুই থাকবে না।

আকাশ আমার বন্ধু ছিলো। ভালো বন্ধু বলা যায় কিন্তু খুব বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমাদের ছিলো না। ২০১১ সালে বিশেষ এক ঘটনা এবং আবাসিকে ভর্তির পর আমি বন্ধুদের থেকে সবসময় কিছুটা দূরে দূরেই থাকতাম। স্কুল লাইফটা সালের হিসেবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় সকলকেই এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু কলেজে উঠার পর ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। তখন মাঝে মাঝে চেষ্টা করতাম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার। দুইএকবার স্টেশনে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে। তখন সেই আড্ডায় আকাশ থাকতো। আকাশ আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও ফটোগ্রাফিকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলো। ফটোগ্রাফি যেহেতু একটি সৃজনশীল কাজ আর আমিও লেখালেখি করতাম তাই সেই আড্ডায় আকাশের সাথেই বেশি কথা হতো আমার। 

আকাশকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে চিনি। আকাশের রাগী চেহারা কখনও দেখার সুযোগ আমার হয়নি। আমি ভীষণ ছবি তুলি, আকাশের পছন্দের কাজও ছবি তোলা। কিন্তু আমাদের ছবি মাত্র একটাই। প্রায় ১৪ বছরের পরিচয়ে আমরা প্রথম ছবি তুলি আজ (২ জুলাই ২০২৪) থেকে এগারো দিন আগে (২০ জুলাই ২০২৪)। এই ছবিটাই যে প্রথম আর শেষ ছবি হবে জানা থাকলে কোনদিন ছবিটা তুলতাম না। কারণ এই একটি ছবির অসহনীয় তাড়নার জন্যই এত বিশাল লেখা। 

জানি বাকী জীবনে যতদিন এই ছবিটা দেখবো ততদিন এই ছবি আমায় কুড়ে কুড়ে খাবে। আকাশের সাথে আমার সমস্ত স্মৃতি আকাশেই ছড়িয়ে পড়বে। আকাশ দেখতে হয় মাথা উঁচু করে। কিন্তু যখন স্মৃতির চাদরে আবৃত সেই আকাশ দেখবো তখন চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসবেই। মনে জেগে উঠবে ভাবনা, মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে আকাশ...এরপর.....

প্রচন্ড তৃষ্ণা বুকে নিয়ে;
মৃত্যু আসে।
জীবন নামক মায়াঘর, এবার ভাঙার পালা।
ঐহিক যেন মুহূর্তেই ডুবন্ত সূর্যের মতো
হঠাৎ,নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
স্মৃতিগুলো ঘোলাটে হতে হতে,
আঁধারে মিলিয়ে যায়।
চারিদিকে কান্নার রোলে, ভারি হয় বায়ু;
কেবল পরে থাকে একটি নিষ্প্রান লাশ।
(মৃত্যুর রোজনামচা : মারিয়া হক শৈলী)

 

লেখক: ওয়াজেদ হোসেন জীম, গাইবান্ধা

 

রাজু

×