তাঁর লেখার স্বতন্ত্র্য, তথ্যবিন্যাস ও ভাষাভঙ্গি পাঠকের চেতনাকে আলোড়িত করে। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন সব্যসাচী লেখক, গবেষক ও সম্পাদক। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ১৫০টি। মান্নান সৈয়দ শুধুমাত্র ‘কবি’ হয়ে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি; সে কারণে নিজেকে প্রবন্ধ রচনা, আলোচনা ও সম্পাদনায় ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘সত্যের মতো বদমাশ’ গল্পটি (১৯৬৮) সালে প্রকাশিত হলে তারুণ্য ও নতুন প্রজন্ম তা সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয়। তাঁর গল্প-উপন্যাসের ভাষা কবিতাময়ী, ব্যতিক্রমধর্মী, রূপকধর্মী বিবরণ ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন নিজের কাছে, তাঁর পাঠকের কাছে। তিনি ছিলেন নীলকণ্ঠী। কষ্টের এক জীবনের পরতে পরতে বিষাদ, বেদনা ও আনন্দকে তিনি একসঙ্গে ধারণ করেছেন। ষাট দশকে মান্নান সৈয়দ ‘মাতৃ হননের নান্দী পাঠ’ গল্পে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সত্যের মতো বদমাশ’ প্রকাশিত হলে গ্রন্থটি পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দের ২৮টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পসংগ্রহ। ‘জলপরি’, ‘কে তুমি’ ও ‘চোখ’ অন্তর্জগতের কথায় অগ্রগণ্য হয়েছে। ‘চলো যাই পরোক্ষে’ গল্পে তিনি পাঠককে নতুন ভাবনায় দীক্ষিত করেছেন। গতিশীল, মার্জিত ও কাব্যিক ভাষার সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। গ্রাম্যতাবর্জিত চিত্তজয় করা গল্প তাঁর মতো কেউ বলতে পারেননি। গল্পে নিরন্তর পরীক্ষা, নিরীক্ষা, উপস্থাপন ভাঙা গড়া ‘মাতৃ হননের নান্দী পাঠ’ থেকে ‘এক অমানুষের’ গল্পে কুশলতা বিস্তৃত হয়েছে। বুনন, গঠন ও কারুকাজ মান্নান সৈয়দের গল্পের প্রাণশক্তি। আনন্দ পাঠ তাঁর গল্পে পাঠকের বাড়তি পাওনা।
কথাসাহিত্যে মান্নান সৈয়দ সমানভাবে উপস্থিত।
১৯৭২ সালে জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শুদ্ধতম কবি’ প্রকাশিত হলে সে সময় তিনি নিজেকে সাহিত্যের সব শাখাতেই উন্মোচন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০২-১৯৮১), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), অজিত দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯), সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), আল-মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯), শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) ইত্যাদি সাহিত্যকর্ম নিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচনা করেছেন। এদের সঙ্গে তাঁর উৎসাহী দৃষ্টিতে উঠে এসেছিল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকদের সাহিত্য দর্শন, তত্ত্ব ও তথ্য। জীবনানন্দ দাশের পাশাপাশি কবি কাজী নজরুল ইসলামের দিকে তাঁর মনোযোগ বেশি ছিল। জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত রচনা উদ্ধার করে তিনি ‘শিল্পকলা ও কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় বহুমাত্রিক ভাবনার ঋদ্ধ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর রচিত প্রবন্ধের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গ্রন্থ তালিকাগুলোর কথাই এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ : শুদ্ধতম কবি (১৯৭২), জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪), সমালোচনা সমগ্র: জীবনানন্দ দাশ (১৯৮৩ সম্পাদিত), জীবনানন্দ (১৯৮৪), জীবনানন্দ-১ (১৯৮৪ সম্পাদিত), কিছুধ্বনি (জীবনানন্দ সংখ্যা ১৯৯৩ সম্পাদিত), সমগ্র কবিতা: জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৩ সংকলিত সম্পাদিত), জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (কবির স্বহস্তে লিখিত ৪৮টি পত্র ও তাকে লেখা ৫টি পত্রের সংকলন ১৯৮৭-তে সম্পাদিত), জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯ সম্পাদিত), প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র: জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৪ সম্পাদিত), বনলতা সেন: জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৬ সম্পাদিত) ও রূপসী বাংলা: জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৬ সম্পাদিত) ইত্যাদি গ্রন্থমালা মান্নান সৈয়দের উল্লেখিত গ্রন্থ।
মান্নান সৈয়দের উল্লেখিত গবেষণা প্রবন্ধ: কবি ও কবিতা (১৯৭৭), আমার বিশ্বাস (১৯৮৪), ছন্দ (১৯৮৫), চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে (১৯৮৯), পূর্ণবিবেচনা (১৯৯০), দরোজার পর দরোজা (১৯৯১), বিবেচনা-পূর্ণবিবেচনা (১৯৯৪), রবীন্দ্রনাথ (২০০১), ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী (২০০৭) ও বিংশ শতাব্দীর শিল্প আন্দোলন (২০০৮)।
শুদ্ধতম কবির প্রথম অধ্যায়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ইংরেজি কবিতা ও জীবনানন্দ দাশ। ইংরেজি ও ফরাসি কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার অনুকরণীয় বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘উত্তরবৈরিক ক্যারাভান’ প্রবন্ধ অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২), ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৬-১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), বিষ্ণু দে (১৯৯০), সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত কবিদের আধুনিকতা, বিষয় প্রকরণ ও বক্তব্যকে স্পর্শ করেছে।
তাঁর রচনার অনিবার্য উপকরণ শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদ প্রমুখ। শামসুর রাহমানের কবিতার ‘কলা কুশলতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯৭৬-এ প্রকাশিত ছন্দ, শব্দ, চিত্রকল্পের বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। শামসুর রাহমান একজন নাগরিক কবি। নাগরিক কবির প্রেম, বেদনাবোধ, অশ্রু ও আনন্দ নিয়ে মান্নান সৈয়দ গভীরে প্রবেশ করেছেন। আল-মাহমুদের কবিতায় গ্রাম, প্রকৃতি, সৌন্দর্য বর্ণনা তাঁর কাছে সমর্পিত হয়েছে। এমনকি তাঁর বিশ্বাস রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি অন্তর্লোকেরও পরিবর্তন মান্নান সৈয়দ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ‘আল-মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতা’ প্রবন্ধে তিনি আল-মাহমুদের কাব্যজগতকে আবিষ্কার করেছেন। মান্নান সৈয়দ রচিত কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ: নজরুল ইসলামের কবিতা ও কবিতাগুচ্ছ (১৯৭৭), নজরুল ইসলাম: কালজ কালোত্তর (১৯৮৭), নজরুল ইসলামের কবিতা (২০০৩)।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর লিখিত একটি প্রবন্ধ পাঠক প্রিয় হয়ে ওঠে। মান্নান সৈয়দ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে তাঁর অভিসন্দর্ভ রচনার কাজ করেছিলেন কিন্ত শেষ করেননি। শ্রমলব্ধ তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তবু তিনি বিনয়ের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘দীর্ঘ সযত্ন নিরন্তর মনোযোগে যাদের বিষয়ে উৎসাহি থেকেছি মোটামুটি ধারাক্রম অনুযায়ী তারা হলেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলাম, ফেদেরিকা গারথিয়া লোরকা, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ফররুখ আহমদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শাহাদাৎ হোসেন। তাদের কারো বিষয়ে এমন গ্রন্থ রচনা বা সম্পাদনা করেছি যে কোনো লেখাই আমার বিবেচনায় এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি (আমার গদ্য, আমার বিশ্বাস)। তাঁর রচিত সাহিত্য শিল্পসুষমায় সমৃদ্ধ। আমরা আশা করি নতুন কোনো গবেষক তাঁর গবেষণার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবেন ভবিষ্যতে।
৫০ বছর ধরে মান্নান সৈয়দ সমালোচনা সাহিত্য রচনায় নিবেদিত থেকেছেন। তাঁর মতো জ্ঞানগর্ভ ও বিষয়ের অন্তরালে প্রবেশ করে তথ্য উদঘাটন প্রায় কম সাহিত্যিকই করেছেন। তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাবান, অনতিক্রম্য একজন। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ছাড়াও তিনি লিখেছেন প্রচুর আত্মজৈবনিক রচনা। এর মধ্যে ‘বিষাদময় স্মৃতি, কাছের-দূরের মানুষ’ ও ‘মানবের ভেতরের বিষয়াবলী’ প্রাধান্য পেয়েছে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ কবিতায় শহর, গ্রামের প্রকৃতি, দৃশ্যমান বস্তু, প্রেম- বিরহের কথা ও অন্তর্জগতের পরিবর্তনকে নিষ্ঠার সঙ্গে, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখালেখিতে। তাঁর কথামালা, উপস্থাপনের ভঙ্গি আকর্ষণীয় ও অনবদ্য। মান্নান সৈয়দ যতোদিন জীবনযাপন করেছেন তার পুরোটায় লেখালেখি ও সম্পাদনার কাজে ব্যয় করেছেন। এটা ছিল তাঁর নৈমিত্রিক কাজের মধ্যে একটা। মৌলিক রচনার কাজে কিংবা প্রুফ করায় ব্যস্ত, নিমগ্ন থাকতেন দিনের পর দিন। কবিতায় তিনি নতুন ভাবনা ও বিষয়বস্তুকে সহজ-সরলভাবে অনায়াসেই অনুপ্রবেশ করিয়েছেন। তাঁর সময়ের লেখকরা তাঁর দেয়া তথ্য ও বক্তব্যের ওপর আস্থা রেখেছেন। তাঁর মতো কোনো বিকল্প গবেষক আজো তৈরি হয়নি। তিনি আজো সবার কাছে সমানভাবেই অনুকরণীয় হয়ে আছেন।
পরাবাস্তব কবিতা, দীর্ঘ কবিতা ও ভিন্নধারার কবিতা রচনায় তাঁর নিবিষ্ট মনোযোগ ছিল। তাঁর কবিতা ভাবনা ‘কবিতা মানে রূপান্তর, কবিতা মানে বদল, কবিতা মানে পরিবর্তন’, কবিতা মানে অবৈকল্য নয়, কবিতা মানে তির্যকতা। কবিতা নয় বস্তু ফলক, এমনকি কল্পনা ফলকও নয়। কবিতা বস্তুকে তো রূপান্তরিত করেই এমনকি কল্পনাকেও পরিবর্তন করে ফেলে [করতলে মহাদেশ]।
‘মাছ সিরিজ (১৯৮৪)’, কাব্যগ্রন্থে কবির অন্তর্গত আবেগ, ভাষা ও বক্তব্য অনন্য। জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছে ‘জোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা’, ‘সংবেদন ও জলতরঙ্গ’, কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, পার্ক স্ট্রিটে একরাত্রি, গ্রন্থে তির্যক দৃষ্টিতে আলো ফেলেছিলেন তিনি। ৪২টি ‘চতুর্দশপদী’ কবিতা তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতায় গ্রন্থাবদ্ধ হয়েছিল। কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, গবেষক বহুমাত্রিক পরিচয়ে পরিচিত মান্নান সৈয়দ ছিলেন অতলস্পর্শী।
মান্নান সৈয়দ রচিত জন্মান্ধ কবিতা কাব্যগ্রন্থে কবিতাগুচ্ছ টানা গদ্যে লেখা। অনেকে এ গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোকে ‘কন্টিনেন্টাল প্রোজ পোয়েম’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ছয় দশক কবিতার যে নতুন ধারা বাংলা সাহিত্যে সূচিত হয়েছিল তাতে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁর রচিত কবিতার সমন্বিত ধারায় বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে। উপমা প্রতীক ব্যবহারে পাশ্চাত্য রীতি-নীতিকে তিনি অনুসরণ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমসাময়িক কবিদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর কবিতার চিত্র মানুষের জন্য এক নতুন আলোর দরোজা উন্মুক্ত করেছিল তখন। তাই তাঁর পরাবাস্তব কবিতায় নতুন সংযোজন লক্ষ্য করা যায়: জোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়,
আমার চারদিকে যতোগুলো দরোজা আছে
সময়ের নীলিমার পাতালে জ্বলছে
গাছ সকল সবুজ মশাল, বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।
এরকম দৃশ্যে আহত হয়ে আমি শুয়ে পথের উপর,
আমার পাশের দুচোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে গেল,
আর যে আমার জন্ম হলো
তোমাদের করতলে
মনোজ সে, অশোক সে।
জোৎস্না তাঁর কাছে ভূত,
কিন্তু একটি গানের উপর, দরোজা তার কাছে পুলিশ
কিন্তু একটি জন্মের উপর
মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর।
[অশোক কানন: জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ]