ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

জীবন ও জাগরণের গল্প

জীবন ও জাগরণের গল্প

জীবন থেকে নেয়া জীবন্ত গল্প অথবা গল্পে জীবন দান করে প্রাণ সঞ্চার করা, এমন দ্বিধার দোলাচলে দুলতে দুলতে পুনর্বার সূচিপত্রে চোখ বুলিয়ে ফিরে পাওয়া সম্বিত নিয়ে গল্পের ভেতর আবার ডুবে যাওয়া। এমন ঘোর লাগানো শৈল্পিক সৃষ্টির পসরা সাজিয়ে পাঠকের সামনে যখন কোনো গল্পগ্রন্থ ধরা দেয় তা অবশ্যই সুপাঠ্য গ্রন্থই বটে! বহুমাত্রিক লেখক পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ এমনই এক চমকপ্রদ গল্পের বই। পীযূষ কান্তি বড়ুয়া গল্প বলেন তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে। যাপিত সময়ের বাস্তবতা ও চেতনার জাগরণ সৃষ্টি করে তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু। সাবলীল এবং সহজ ভাষায় অতি পরিচিত ও সাধারণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে অসাধারণ জীবনবোধের গল্প তুলে আনেন তিনি যার সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। পরম ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ভিতে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের প্রিয় সম্পর্কগুলো। প্রেম-প্রণয়ের এই পথচলায় কখনো কখনো ফাটল ধরে উটকো সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাসের বিষাক্ত থাবায়। আত্ম-অহংবোধের অদৃশ্য দেয়াল ক্রমশই দূরে ঠেলে দেয় আত্মার বাঁধনে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষকেও। কিন্তু যখন ভুলের অধ্যায়ের অবসান হয় তখন আর কারুরই ফেরার সময় থাকে না। অথচ দুজনেই শেষ পরিণতিতে নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চেয়েছেন। এভাবেই এক দম্পতির ভালোবাসার গল্প হয়ে ওঠে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। অসাধারণ এই গল্পটি পড়ার পর যে কোনো পাঠক কয়েক মিনিটের জন্য ‘থ’ হয়ে বসে থাকবে এটা নিশ্চিত! এর পরেই পাঠকের যখন ‘বিয়েবার্ষিকীর উপহার’ গল্পটি পড়া শেষ হয় তখন আবার আরেক ভৌতিক ঘোর জন্ম দিয়ে যায়! এটি বইয়ের দ্বিতীয় গল্প। দীর্ঘদিন প্রেমের পর ৩ বছরের সংসার পার করে ডাক্তার অর্ঘ্য মুখোমুখি হয় এক অনভিপ্রেত ভৌতিক রহস্যের সামনে। ‘পাগলিনী’ নামে একটি গল্পে ছোট এক শহরে নতুন এক বৃদ্ধ পাগলের আবির্ভাব ঘটে। পাগলিনী শহরে ঘোরাফেরা করে, শিল্পকলা চেনে, নাট্যকর্মী চেনে এমনকি শিল্পকলার ক্যান্টিনে চা খেতেও সে খুব পছন্দ করে। শহরে ইলিশ উৎসব উপলক্ষে শিল্পকলায় নাটকের আয়োজন হয়। নাটকের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর যখন এক নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতে যায় তখনই পাগলিনী মঞ্চে উঠে চমকপ্রদ এক ঘটনার জন্ম দেয়, হামলে পড়ে মেজরের ওপর। এ ঘটনা শুধু পাগলামি নয়, এ যেন চেতনার বারুদে আগুন দিয়ে জয় বাংলা সেøাগানে জাগিয়ে দেয় পুরো শিল্পকলায় উপস্থিত দর্শকদের। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধ অনেক বীরত্বগাথা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল। এখানে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করে যেমন অনেকে ভূমিকা রেখেছেন তেমনই কেউ কেউ নিজ অবস্থানে থেকেও জন্ম দিয়েছে অসীম বীরত্বগাথার ইতিহাস। হরিপদ মাঝির ছোট্ট ছেলে সুকান্ত বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন দেখতো সেও মিলিটারি মারবে। একদিন মিলিটারি তার গ্রামে এলে সে কৌশলে নৌকা ডুবিয়ে তাদের হত্যা করে। ‘মুক্তিবীর’ এই গল্পটি একইসাথে রোমাঞ্চকর এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এই গ্রন্থে আরেকটি চমকপ্রদ গল্পের নাম ‘জয় বাংলার হাসি’। গল্পের প্রথমদিকে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রেম-প্রনয়, যুদ্ধ- সংকট ইত্যাদি দিয়ে গল্পের প্লট শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মায়ের হাতে নিজ সন্তান খুনের মধ্য দিয়ে জয় বাংলা’র হাসি ফুটে ওঠে। প্রতিটি গল্পই বৈচিত্র্যময় নানা চরিত্র ও ঘটনার মাধ্যমে পাঠককে এক ইন্দ্রজালের জগতে নিয়ে যায়। পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার গল্পে প্রেম-ভালোবাসা, অলৌকিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই বিষয়গুলো সচরাচর চোখে পড়বে যেকোনো সচেতন পাঠকের। এই গল্পগুলো আমাদের চারপাশের চেনা জীবনের কথা বলে। আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে নানা অসঙ্গতি দেখিয়ে দেয়, আমাদের মরিচা পড়া দেশাত্মবোধ ও চেতনাকে জাগ্রত করে তোলে। গল্প পাঠে আগ্রহী পাঠক বইটি পড়লে যেমন বিমোহিত হবেন, একইভাবে নতুন পাঠকও এই গল্পগুলো পাঠ করলে তিনি পাঠের আনন্দ খুঁজে পাবেন তা হলফ করেই বলা যায়! ৮৫ পৃষ্ঠার এই বইটিতে মোট ১০টি গল্প রয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে পরিবার পাবলিকেশন্স। 

একটি অমরফুলের গল্প

একটি অমরফুলের গল্প

এক তরুণের হৃদয়-জমিনে ঝড় তোলে কিছু ধ্বনি, কিছু শব্দ। ধ্বনি আর শব্দের যূথবদ্ধতায় তরুণের মস্তিষ্কে সহসা আগুন লাগে। বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না কিছু। তরুণের মনে হয়, ক্রমশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যেতে থাকে চারপাশ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শূন্যে। শেষে পড়ে থাকে একমুঠো ছাই। ধ্বংসস্তূপের মতো। তরুণ সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর কিছু একটা সন্ধানরত অস্পষ্ট আরেক তরুণের মুখ দেখতে পায়। কী খোঁজে সে? প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে, জানি না কী খুঁজি...! এতটুকুই স্বপ্নে দেখে শরীফ। অনেকদিন পর আজ স্বপ্নটা আবার হানা দেয় তার ঘুমে। চোখ মেলে সে তাকায় সিলিংয়ের দিকে। বাইরের মৃদু আলোতে শোঁ শোঁ শব্দে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান চোখে পড়ে। আজ আর ঘুম আসবে না তার। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে শরীফ, ওয়াশরুমে যায়। ফিরে এসে পশ্চিমের জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দিতেই ঠান্ডা হাওয়ার পরশ এসে শীতল করে দেয় শরীর। সে বাইরে তাকায়। দেশে থাকতে মধ্যবসন্তের রাতের শেষে এতটা কুয়াশা হতে সে কখনো দেখেনি আগে। সে দেশ ছেড়েছে চব্বিশ বছর হলো। কতকাল পরে বসন্তের রাত শেষের এমন এক সময়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তার। ঘড়ি দেখে শরীফ। সাড়ে চারটা প্রায়। মেজভাই কিছুদিন হল ফয়েজলেক সংলগ্ন এ জায়গাটিতে চারতলা বাড়িটি বানিয়েছে। মেজভাই পরিবারসহ তিনতলায় থাকে। বাকিটা ভাড়া। বিল্ডিংয়ের পেছনে, পশ্চিম দিকে অনেকখানি খালি জায়গা, গাছগাছালিতে ভরা, একটি কলাগাছের বড়সড় ঝোঁপ। আরো পশ্চিমে, অদূরেই পাহাড়ে শিরিষ গাছের সারি। তার দক্ষিণ দিকে নাকি একটা ছাত্রী হোস্টেল। আর পূবের দিকে গড়ে উঠেছে হাউজিং সোসাইটি। বিল্ডিংয়ের উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে আরেকটা পাহাড়ের কিয়দংশ চোখে পড়ে। পাহাড়খেকোদের অস্তিত্বের জানান দিতেই যেন দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের এই ভগ্নাংশ। চট্টগ্রামে আজ শরীফের শেষ দিন। বিকেলের ট্রেনে ঢাকায় ফিরবে সে। সেখানে একদিন থেকেই ফিরে যাব অস্ট্রেলিয়া। ভোরের আযানের ধ্বনি কানে আসে। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে তার। শীতের কুয়াশা এখনো আঁকড়ে আছে বসন্তের ভোর। শীতসন্ন্যাসী ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে নির্ঘাত কিছু কুয়াশা লুকিয়ে রেখে গেছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। এখন সুযোগ পেয়ে তারা জড়িয়ে ধরেছে বসন্ত-ভোর। এই সময়েও তারা কেমন অহংকারী। এখানে-ওখানে তাদের জটলা। দলছুট এই কুয়াশা-দঙ্গলের মৃত্যু ঘটবে আর কয়েকদিন পরেই গ্রীষ্মের তীব্র রোদের তাণ্ডবে। মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে শরীফের। উত্তরের পাহাড়ের একদম ঢালুতে চোখ আটকায় সহসা। এখনো অন্ধকার কাটেনি। ভালো করে খেয়াল করে শরীফ। একজন মানুষের ছায়া চোখে পড়ে। শরীফ অবাক হয়। এমন জঙলা জায়গায় এত ভোরে মানুষ কী করে! তার কৌতূহল বাড়ে; শানিত হয় দৃষ্টি। আবছা অবয়ব দেখে মনে হয় কোনো তরুণ-ই হবে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে উন্মুক্ত এই জায়গাটিতে ঢোকার নিশ্চয়ই কোনো পথ আছে। তরুণের ঘন কালো শরীরের ছায়ায় অস্থিরতার ছাপ। শরীফ দেখতে পায়, সেই ছায়াশরীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন দেয়। তিনতলার জানালায় যেখানে শরীফ দাঁড়িয়ে সেখান থেকে তরুণের অবস্থান ৩০ গজের কম হবে না। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হয় ফোন কল সফল হয়নি। তরুণ সম্ভবত মোবাইলে মেসেজ টাইপ করতে থাকে। যে পথে সে এসেছে সে পথের দিকেই বার বার তাকায়। তাহলে কি কারো আসার অপেক্ষায় আছে সে! কোনো নাশকতার পরিকল্পনা নেই তো তার! শরীফ যখন মনে মনে ভাবে মেজভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে, তখনই অন্য কাউকে একই পথ দিয়ে অতি সাবধানী পায়ে ঢুকতে দেখে তার দৃষ্টিসীমার ভেতর। তরুণ এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে ওপথে যেতে থাকে; ওদিক থেকে আসা মানুষটিও তার দিকেই আসতে থাকে অতি সন্তর্পণে। আবছা অন্ধকারে এমন মুহূর্ত শরীফের মস্তিস্কের কোষে ঘা দেয় জোরে, ভাবনাগুলো জট পাকাতে চায়। কুয়াশাঢাকা ভোরের ঝাপসা আলোয় খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি দুজন তরুণ-তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শরীফ। বিষয়টা এবার খানিকটা পরিষ্কার হয় তার কাছে। তার অবস্থান থেকে সে দুজনের একপাশটা দেখতে পায়। তরুণীর মুখ কাপড়ে ঢাকা। পিঠময় ছড়িয়ে আছে একরাশ চুল। পাহাড়ের গায়ে আলো ফুটতে শুরু করে ধীরে। সে আলোয় দুজনের মাথার ওপর ক্লান্ত এক নিমগাছকে ভোরের হাওয়ায় তার পাতাগুলোকে মৃদু দোলাতে দেখে শরীফ। কুয়াশা সারারাত তার দাপট চালিয়েছে নিমগাছের শাখা-প্রশাখায়। গাছের কাঁচা সবুজ রঙের পাতা আর সদ্য ফোটা নীলচে ফুলগুলো ভিজে একাকার। শরীফের মনে হয় আকাশ ক্রমশ নেমে আসে কাছে; আরো কাছে। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে তাকে। দুজন পরস্পরকে ব্যক্ত করে তাদের একান্ত অভিলাষ। তরুণ তার হাতের মোবাইলটি দেখাতে থাকে তরুণীকে। শরীফ দূর থেকে তাদের শরীরী ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। পশ্চিমের পাহাড় থেকে ভোরের কাকগুলো তাদের কর্কশ ধ্বনিব্যঞ্জনায় আর ডানার ঝাপটায় কুয়াশার চাদর চিরে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়, রাতের আঁধার মুছে আবাহন করে সূর্যের। তরুণটি আঙুলে আঙুল জড়াতে চায়। তরুণীর আড়ষ্টতা তখনো কাটেনি। তার একটা হাত অদৃশ্য। কিছু কি আছে সেই হাতে? এটাই কি প্রথম প্রেমালাপন তাদের? আনমনে ভাবে শরীফ। মুহূর্তটা কেমন মায়ায় গেঁথে ফেলে পুরো পরিবেশটাকে। প্রভাতের নব আলো তাদের জানান দেয়, এখানে মিথ্যে সামাজিকতার ভড়ং নেই; ভয় নেই হারিয়ে যাবার; ভয় কেবল বিলীন হবার। দুজনের মধ্যে হঠাৎ নেমে আসে নীরবতা। এই নীরবতার শুরু বা শেষ বলে হয়তো কিছুই নেই। ধবধবে সোনালি রঙের এক সকাল নামে। কুয়াশাদল মাত্র বিদায় নেয়। চোখের ক্লান্তি জুড়োতে কচি কলাপাতা ব্যস্ত হয়ে ছড়িয়ে দিতে থাকে সবুজ রঙ। কোথা থেকে এক দমকা হাওয়া এসে হঠাৎ মৌনতা ভেঙে দিলে তরুণীর মুখ থেকে খসে পড়ে শুভ্র আবরণ। তার অদেখা অর্ধেক মুখে এসে পড়ে আলো। শরীফের ভেতরটায় প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। এ কী দেখছে সে!। বহুকাল আগে দেখা একান্ত আপন এক মুখ আজ এতকাল পরে আবার দেখে সে! এ-ও কি সম্ভব! নিশ্চিত হতে রুমের দরজা খুলে দক্ষিণের বারান্দায় যায় শরীফ। বারান্দা থেকে তরুণীর মুখ ভালো করে দেখে সে। অবিকল একই মুখ! কে এই তরুণী?  নিমফুলের পাপড়ি থেকে খসে পড়া শিশির তরুণীর মুখে পড়লে সে হাত দিয়ে মুখটা মোছে, আচমকা কী ভেবে ওপরের দিকে তাকায় আর তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শরীফের চোখে। সহসা সে কি লজ্জা পায়, না কি ভয়! বোঝে না শরীফ। তখনই খসে পড়া নেকাবটি আবার সে মুখে জড়ায়, কিছু একটা বলে তরুণকে। তরুণও মুখ ঘুরিয়ে শরীফকে দেখে এবার। তরুণী হঠাৎ দ্রুত হাঁটতে থাকে যে পথে সে এসেছিল সেই পথের দিকে। তরুণও তার পিছু নেয়। শরীফের ইচ্ছে করে সে চিৎকার করে ওদের বলে, তোমরা যেয়ো না! তোমাদের অভিবাদন জানাতে আবার নামবে ভোরের কুয়াশারাশি!। যেয়ো না। একবার বলে যাও তোমাদের পরিচয়! কিন্তু নিজেকে তার বোবা মনে হয়, তার কণ্ঠে কোনো স্বর বাজে না আর। সহসা সে শুনতে পায় ভোরের হাওয়ায় বাজতে থাকা হাহাকারধ্বনি। শরীফ ঘোরগ্রস্তের মতো তিনতলা থেকে নিচে নেমে আসে। দারোয়ানকে ফজরের নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে ফিরতে দেখে। তাকে ওদিকে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করলে সে পথ দেখিয়ে দেয়। উ™£ান্তের মতো অনেকটা দৌড়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় শরীফ। হারিয়ে যাওয়া যুগলকে এদিক-ওদিক খোঁজে। কোথাও দেখা যায় না তাদের। এমন-কি তাদের কোনো চিহ্নও চোখে পড়ে না তার। কলাগাছের ঝোপে, নিমগাছে, কাছে বা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ে বাজতে থাকা ভোরের পাখির কলতান থেমে যায় হঠাৎ, মুহূর্তে সেখানে নেমে আসে মৌনতা। নিজেকেই সহসা অপরাধী ভাবতে থাকে শরীফ। ভাবে এটা তারই বোকামির ফল। ঘাসের বুক তখনো শিশিরভেজা। অগত্যা শরীফের দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে যায় ভোরের বাতাসে। ফিরে যেতে থাকে সে। আচমকা নিচে ঘাসের ওপর চোখ আটকে যায় তার। দেখে একটি ফুল। এই ফুলের সঙ্গে তার প্রণয় হয়েছিল আটাশ বছর আগে। সেদিন গ্রামের মেঠোপথে বিকেলের সোনালি আলোয় দুজন তরুণ-তরুণী হাঁটছিল। তীর্থের কাকের মতো তরুণ অপেক্ষা করছিল তরুণীর কাছ থেকে আকাক্সিক্ষত প্রতিউত্তরের। অপেক্ষা মাস পেরিয়ে বছর গড়ায়। হয়তো বিধাতার করুণায়ই হঠাৎ তরুণের অপেক্ষার অবসান হয়। সেদিন গ্রামের সেই পড়ন্ত বিকেলে মেঠোপথের পাশে ফোটা অমর গাছ থেকে তরুণী যত্ন করে একটি ফুল ছিঁড়ে তরুণের হাতে দিয়ে ইঙ্গিতে জানায় তার উত্তর। সেদিনের সেই সুখটুকুই তরুণের জীবনে আসা প্রেমের প্রথম অনুভব। অতঃপর যুগলজীবনের শত প্রতিশ্রুতির পরও শেষপর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটে সেই অসামান্য প্রণয়ের। এত বছর পর আজ আবার শরীফ দেখে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা সেই অমর ফুল! কে এনেছিল? নিশ্চয়ই সেই তরুণী? এতসব ফুল থাকতে কেন তার হাতেও অমর ফুল! পোড়ো জমি থেকে বেরিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে শরীফ। না। আশপাশে কোথাও অমর গাছ চোখে পড়ে না তার। তাহলে কোথা থেকে এল এই ফুল! আবার সে ফিরে যায় আগের জায়গায়। এতক্ষণ যা কিছু দেখল সে তা কি সত্যি, না কি তার ভেতরে বাস করা কোনো অতীত সুযোগ পেয়ে হামাগুড়ি দেয় তার মনে! ভাবনাটা পেয়ে বসে তাকে। কিন্তু তার সামনে, ঘাসের ওপর তখনো দিব্যি ফুটে থাকে একটি অমর ফুল! এই অমর ফুল তো মিথ্যে নয়, ভাবে সে আবার। তবে কি প্রকৃতিতে সবকিছুই থেকে যায় ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্যরূপে; এ চৈতন্যের নামই কি তবে প্রেম! অমরফুলটিকে ঘাস থেকে তুলে হাতের তালুতে নিতেই বাতাসে ভেসে আসে বহুকাল আগের এক কথোপকথন, - উত্তর দিতে এতটা সময় নিলে? - আজ সম্ভবত পূর্ণিমা! - তাতে কী?  - নতুন চাঁদকেও অপেক্ষা করতে হয় পূর্ণিমার জন্য। অন্যজন মনে মনে বলে, -কৃষ্ণপক্ষও গিলে খায় পূর্ণিমার আলো। - চুপ কেন, কী ভাবছ? - ভাবছি, অমর ফুলটা কী এক আকর্ষণে জড়ালো আমাদের!   কথোপকথনে সহসা হানা দেয় অন্য একটি বেসুরো কণ্ঠস্বর। ভাইজান, এইখানে কী করেন? মুখ ঘুরিয়ে মেজভাইয়ের বাড়ির দারোয়ানকে আবিষ্কার করে শরীফ। তাকে খুঁজতে এসেছে বেচারা। অমরফুলটি আড়াল করতে করতে শরীফ বলে, জানলা দিয়ে জায়গাটা দেখে ভালো লাগল। তাই ঘুরতে বেরিয়েছি। বলতে বলতে ঘরে ফিরে আসে শরীফ। মুখে অনেকক্ষণ পানির ঝাপটা দেয়। আর নিজের মনেই বিড়বিড় করে নিজেকে শোনায়, যতটুকু দেখলাম তা কোনো এক উপ্যাখ্যানের অসামান্য অংশবিশেষ, তার অপ্রকাশিত বেদনাটুকু নিয়েই এবার ফিরতে হবে প্রবাসে, সাথে অমরফুলের রং।

মধুসূদন দত্তের নাট্যসাহিত্যের আলোকিত ভুবন

মধুসূদন দত্তের নাট্যসাহিত্যের আলোকিত ভুবন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন একজন অগ্রসর কবি ও নাট্যকার। তার নাট্য সাহিত্যে সমাজ ও পরিপার্শ্ব চিত্রিত হয়েছে। মাইকেলের কবিতা, নাটক, তার ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য প্রহসন রচনার কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাইকেল আধুনিক নাট্যকার হিসাবে সমধিক পরিচিত। বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি আবির্ভূত হন নাটক রচনার মাধ্যমে। নাট্যকার হিসেবেই শুরুতে মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কবিতার পাশাপাশি নাটক রচনার ক্ষেত্রে তার সপ্রতিভ উজ্জ্বল উপস্থিতি সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। তিনি একজন নাট্যকার হিসেবে খুব সহজে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি কবিতা রচনা করেও বাংলা সাহিত্যকে তিনি আলোকিত করেছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মধুসূদন আলাদা লৈখিকরীতি, নতুন নাট্য সাহিত্য ও কাব্য ভাবনা, বক্তব্য, ভাষাভঙ্গি দিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেন। তার রচনায় জীবন ঘনিষ্ঠতা ও প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি গতানুগতিক ধারাকে পরিহার করে নতুন ধারা নির্মাণে ব্রতী হন। আলাদা পথে তিনি সাহিত্য সাধনায় অগ্রবর্তী থেকেছেন। তার রচিত নাটক গভীরতায় সম্প্রসারিত হয়েছে। মধুসূদন দত্ত নাটক রচনার বিষয় বৈচিত্র্যে, বর্ণনার ও রূপব্যঞ্জনা নির্মাণে আধুনিক রূপায়ণ ঘটাতে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেটের প্রবর্তক। তিনি স্বার্থক কমেডি ও ট্র্যাজেডি নতুন মাত্রা দিয়ে উজ্জ্বল প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। তার স্মরণীয় রচনা তাকে আদৃত করেছে। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত। মাইকেলের পিতা ছিলেন জমিদার। তার মায়ের জাহ্নবী দেবী। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীর মুখে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি শোনেন ছেলেবেলায়। তেরো বছর বয়সে মদুসূদন দত্ত কলকাতা যান এবং স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনার পর তিনি সে সময়কার হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। তিনি বাংলা, ফরাসি ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতার বিশপস কলেজে অধ্যয়ন করেন। এখানে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন। পরবর্তীতে আইনশাস্ত্রে পড়ার জন্য তিনি ইংল্যান্ড যন।  তিনি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যেও অসামান্য অবদান রাখায় বিশ্ববাসী এ ধীমান কবিকে মনে রেখেছে কৃতজ্ঞচিত্তে। পাশ্চাত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৮৪৩ সালে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং মাইকেল উপাধি গ্রহণ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর কীর্তির যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় তিনি মনোক্ষুণ্ন্ন হয়ে পড়েন। ইংরেজি সাহিত্য থেকে দূরে সরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কালজয়ী রচনাবলীর অন্যতম হলো মেঘনাদবধ কাব্য, ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, কৃষ্ণকুমারী, বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ, পদ্মাবতী, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, হেক্টরবধ, চতুর্দশপদী কবিতাবলী।  ১৮৫৯ সালে রচনা করেন পৌরাণিক নাটক শর্মিষ্ঠা। ১৮৬০ সালে রচনা করেন একেই বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ এবং পদ্মাবতী নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। এরপর ১৮৬১ সালে মেঘনাদ বধ মহাকাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক, ১৮৬২ সালে পত্রাকাব্য বীরাঙ্গনা এবং ১৮৬৬ সালে চতুর্দশপদী কবিতাবলী রচনা করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক তিনি। সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তিনি প্রথম মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ রচনা করে তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। পাঠকদের কাছে ভীষণভাবে অভিনন্দিত হন। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি মধুসূদন দক্তের ভীষণ আকর্ষণ ছিলো। ইংরেজি সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন বলেই তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিতা গল্প নাটক উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করার বাসনা তার ছিলো। মধুসূদন দত্তের স্বপ্ন ছিলো ইংরেজি সাহিত্য রচনা করে শেক্সপিয়র, মিল্টনের মতো খ্যাতিমান হবার। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যে তার রচনা তেমন চমক সৃষ্টি করতে পারেনি। তখন তিনি ব্যর্থতা নিয়ে বাংলা সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। আকস্মিকভাবেই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার বিচিত্র নাট্যসাহিত্যের কিছু নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। পাইকপাড়ার রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে একটি নাট্যচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাম নারায়ণ তর্কাবত্নের রত্নাবলী ও নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করার দায়িত্ব মধুসূদন দত্তের উপর অর্পিত হয়। এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো মূলত ইংরেজ দর্শকদের চাহিদা বিবেচ্য নয়।  ১৯১৮ সালে মধুসূদন দত্ত প্রচলিত সংস্কৃত রীতির বাইরে গিয়ে শর্মিষ্ঠা নাটক রচনা করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের সুর নতুনভাবে অনুরণিত হতে দেখা যায় মধুর সাহিত্যে। তিনি নাট্য সাহিত্যের নতুন ধারা আবিষ্কারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ ও রূপান্তরের মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন তার রচনা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে মহিমান্বিত করেছেন। ২৯৫৯ সালে মধুসূদন রচিত পদ্মাবতী নাটকটি গ্রীক উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত হয়েছে। এই নাটকে প্রথম অমিতাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। পদ্মাবতী নাটকে নারীর সৌন্দর্যের ঈর্ষাকে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে রচিত পদ্মাবতী নাটকে ভারতীয় পুরাণ এবং সমাজের নানা চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা সমাজের বিরাজমান নানা অসঙ্গতি অনিয়ম ঘাত প্রতিঘাত বিদ্রোহ মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাট্যসাহিত্যের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক অনিয়ম দুরাচার তাকে ব্যথিত করেছে। তিনি এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে তাই রচনা করেছেন সামাজিক রম্য রচনা, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো। মাইকেলের এ ধরনের রচনায় ইয়াং বেঙ্গলে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের বেপরোয়া জীবন যাপনের চিত্র উঠে এসেছে। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনা। সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু ধর্মের মানুষদের উদ্দেশ্যে বিদ্রƒপ প্রকাশ পেয়েছে মধুসূদনের এ ই রচনায়। মধুসূদন দত্ত অন্য সব কবি সাহিত্যাকদের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ঘুণে ধরা সমাজে বাস করা করা কপট মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারেননি মধুসূদন। চারপাশের নানা অনিয়ম বৈষম্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি ঘৃণা প্রকাশে সচেষ্ট থেকেছেন মাইকেল তার সাহিত্য রচনার মাধ্যমে। শর্মিষ্ঠ মধুসূদন দত্তের প্রথম সার্থক নাটক। এই নাটকটি ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শর্মিষ্ঠা একটি পৌরাণিক নাটক। নাটকটি ভীষণভাবে চমক সৃষ্টি করে। পাঠক দর্শকদের কাছে প্রিয়তা পায়। সে কারণে এই নাটকটি বারবার সফলভাবে মঞ্চায়িত হয়। শর্মিষ্ঠার আখ্যান মহাভারতের আদিপর্ব থেকে নেওয়া হলেও নাটকের প্রয়োজনে কাহিনীতে বহু পরিবর্তন ঘটিয়ে তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ত্রিকোণ প্রেমের এই নাটকে দেবযানির সঙ্গে যযাতির প্রেম বিয়ে ও সংসার জীবনের কাহিনী অন্তরঙ্গময় ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। শর্মিষ্ঠার নির্বাসন জীবনের যাতনা পরবর্তীতে যযাতির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনার বর্ণনা মধুসূদন অসাধারণ দক্ষতায় দিয়েছেন। শর্মিষ্ঠা উপন্যাসে। হিন্দুপুরাণের কাহানী ধারণ করে এই নাটকে অগ্রযাত্রা সে কারণে বলা যায় যযাতির জরাগ্রস্ততা ও জরামুক্তি প্রসঙ্গের মাধ্যমে পার্থিব চাওয়া পাওয়ার বিপরীতে বৈরাগ্য সাধনা দিক এই নাটকে উন্মোচিত হয়েছে। সমাজের অবক্ষয়, অসঙ্গতি মধুসূদন তুলে ধরেছেন। যা বাংলা সাহিত্যে সেসময়ে নতুন মাত্রা যোগ করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রহসন রচনার মাধ্যমে কৌতুক ও হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে সমাজের অবক্ষয় ও নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন অসাধারণ দক্ষতায়। প্রহসনকে বলা হয় নাটকের উপশাখা মধুসূদন দত্ত প্রহসন রচনায় অদ্বিতীয় ও তুলনারহিত।আর কেউ তার মতো সার্থক প্রহসন রচনা করেছে এমন খবর পাওয়া যায় না। মাইকেল মথুসূদন দত্তকে আথুনিক বাংলা নাটকের জনক বলা যায় দ্বিধাহীনভাবে। মাইকেলের সাহিত্য পাঠকদের বিপুলভাবে আকৃষ্ট করে। মধুসূদন দত্তেন প্রহসন “একেই কি বলে সভ্যতা” হলো দুই অঙ্ক বিশিষ্ট প্রহসন। এই প্রহসনে রয়েছে প্রতি অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক বা দৃশ্য। এর পটভূমি আধুনিক কোলকাতা।নববাবুরা পাশ্চাত্য প্রভাবিত হয়ে যে সব অপকর্ম করে তা তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত এই প্রহসন। ইয়ংবেঙ্গল বা নববাবুদের চরিত্রের ত্রুটি উঠে এসেছে এখানে। কেবল মাত্র আড্ডার উদ্দেশ্য থেকে নববাবু ও তার বন্ধুরা মিলে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। এ ক্লাবে চলতো অবাধে মদ্যপান। এবং বারবণিতাদের নিয়ে চলতো অতিশয় নগ্ন মত্ততা। নবকুমারের বাবা গোঁড়া হিন্দু বৈষ্ণব। তিনি সবসময় ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে চান। কিন্তু তার বন্ধু কালীনাথ ভালোমানুষীর অভিনয় করে নববাবুর বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওকে ক্লাবে নিয়ে যায়। নবকুমারের বাবার সন্দেহ থেকেই যায়। নববাবুর বাবা ওদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না। তাই তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে ক্লাবের উদ্দেশে পাঠান। প্রহসনটিতে ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনার মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন পথভ্রষ্ট নষ্ট যুব সম্প্রদায়ের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন।  মদের নেশায় মাতাল অবস্থায় নববাবুকে নিয়ে বৈদ্যনাথ বাড়ি ফেরার পর বাবা, মা, স্ত্রীসহ বাড়ির সকলে ছুটে আসে। নববাবু তখন মদের নেশায় অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে। এ সময় স্ত্রী হরকামিনী ধিক্কার দিয়ে বলেন : ‘এমন স্বামী থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। ঠাকুর ঝি! তোকে বলতে কি ভাই, এইসব দেখেশুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি। ছি, ছি, ছি ! বেহায়ারা আবার বলে কি, যে সাহেবদের মতন সভ্য হয়েছি, হা আমার পোড়া কপাল! মদ খেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয়? একেই কি বলে সভ্যতা?’ ‘একেই কি বলে সভ্যতা’। এই প্রহসনে মধুসূদন দত্ত শহরের সমাজজীবনের অবক্ষয় চিত্ররূপ নিপুণ কুশলতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মধুসূদন দত্তের দুই অঙ্ক বিশিষ্ট নাটিকা বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সমাজের বিপরীতমুখী বাস্তব চরিত্রকে অবলম্বন করে তিনি এই সার্থক প্রহসন রচনা করেছেন। সমাজের বিত্তবান এক বৃদ্ধ ভক্তপ্রসাদকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী এগিয়ে গেছে। বৃদ্ধ বয়সে কাম প্রবৃত্তিতে আসক্ত মানুষের স্বরূপ এ রচনায় উন্মোচিত হয়েছে। মধুসূদন দত্ত দক্ষতার সাথে, চরিত্র নির্মাণ ও বর্ণনা মাধুর্যে তার এই রচনা আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই রচনার চরিত্রগুলো হচ্ছে,মূল চরিত্র  ভক্ত প্রসাদ তার অনুচর গদাধর, দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাচস্পতি, রায়ত হানিফ গাজি, হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমা, খল স্ত্রীচরিত্র পুঁটি আরও আছে পঞ্চী ও পঞ্চীর মা ভগি। প্রচণ্ড খরার কারণে ধান ভালো না হওয়ায় হানিফ গাজি ভক্ত প্রসাদকে কীভাবে খাজনা দিবে এ নিয়ে ভাবনায় পড়ে যায়। খাজনা কিছুটা মওকুফের জন্য সে গদাধরকে কাছে ডায়। ভক্ত প্রসাদ এ কথা শুনে ভীষণ ক্ষেপে যায়। এক পর্যায়ে গদা তার মনিবকে হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমার কথা বললে ভক্ত প্রসাদের রাগ কমে। সে ফাতেমার সঙ্গে কীভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করবে সেই ফন্দি করতে থাকে। শুধু ফাতেমা তা নয় অনেকের প্রতিই তার কাম বাসনা জাগে। যেমন গ্রামের যুবতী মেয়ে পঞ্চীর ওপর তার কুদৃষ্টি পড়ে। এখানে ভক্ত প্রসাদের লাম্পট্য বহুগামিতার প্রকাশ ঘটেছে। ভক্ত প্রসাদ জানতে পারে তার ছেলে কোলকাতায় থেকে নাকি মুসলমান বাবুর্চির রান্না খায়। এ কথা জেনে ভক্ত প্রসাদ ভীষণ রেগে যেয়ে বলে ‘থু! থু! ‘হিন্দু হয়ে নেড়ের ভাত খায়’। রাম!রাম! থু!থু!’ তখন গদাধর স্বগত উক্তিতে বলে- ‘নেড়েদের ভাত খেলে জাত যায় কিন্তু তাদের মেয়েদের নিলে কিছু হয় না। বাঃ!বাঃ!’ অবশেষে ভক্ত প্রসাদ ফাতেমাকে ভোগ করার তীব্র লিপ্সা নিয়ে শিবমন্দিরের ভিতরে ঢোকে। তার কাছে দেবালয় বা ধর্ম বড় ব্যাপার নয় ভোগটাই আসল। তবে ভক্ত প্রসাদ ব্যর্থ হয়। হানিফ গাজি ও বাচস্পতির বুদ্ধি ও কৌশলের কাছে সে হেরে যাই। ফাতেমাকে ভোগ করতে পারে না ভক্ত প্রসাদ। ফাতেমা রক্ষা পায় ভক্ত প্রসাদের লালসা থেকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সমাজের নানা চিত্র গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে তার নাট্যসাহিত্যে তুলে ধরেছেন। তিনি নাটক রচনায় বিষয়-বৈচিত্র্য, বর্ণনারীতি ও চরিত্র নির্মাণে আধুনিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। নাট্যসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর চিহ্নিত করা যায় খুব সহজেই। 

আমার আঁধারে

আমার আঁধারে

কোনোদিন যদি ভীষণ দুর্যোগ আসে ‎সারারাত ঝড়ো বাতাস বয় দিগন্ত জুড়ে; ‎তোমার অগাধ ঐশ্বর্য তবু রবে অক্ষত ‎আমার শূন্য উঠোন তুমি ফসলে দিও ভরে। ‎ ‎বিকেলের রোদটুকু যদি কভু ম্লান হয়ে যায় ‎হঠাৎ সন্ধ্যা নেমে চরাচর আঁধারে ভাসে; ‎জানি তোমার হৃদয়ের তাপ আলোর অধিক ‎তুমি জ্বেলে দিও দীপ খুব ভালোবেসে। ‎ ‎ধরো যদি কোনোদিন কোলাহল থেমে যায়, ‎নির্জন হয়ে যায় এই মুখরিত অন্তঃপুর; ‎তোমার বীণার গান সেদিনও যেন বাজে ‎তার আবেশে মাতিও আমার হৃদয়-সমুদ্দুর। ‎ ‎যবে আমার দিনের শেষে হবে যাত্রা শুরু ‎আধাঁর ভরা ঐ যাত্রায় আলোর দিশা হয়ও; ‎অস্তিত্ব আমার যেন না হয় বিলীন ‎অশেষের মন্ত্রে আমায় তুমি অমরতা দিও।